ধান ক্ষেত























রাখালের রাজগী
জসীম উদ্‌দীন---ধান ক্ষেত
রাখালের রাজা! আমাদের ফেলি কোথা গেলে ভাই চলে,
বুক হতে খুলি সোনা লতাগুলি কেন পায়ে দলে?
জানিতেই যদি পথের কুসুম পথেই হইবে বাসি,
কেন তারে ভাই! গলে পরেছিলে এতখানি ভালবাসি?
আমাদের দিন কেটে যাবে যদি গলেতে কাজের ফাঁসি
কেন শিখাইলে ধেনু চরাইতে বাজায়ে বাঁশের বাঁশী?
খেলিবার মাঠ লাঙল বাজায়ে চষিতেই যদি হবে,
গাঁয়ের রাখাল ডাকিয়া সেথায় রাজা হলে কেন তবে?

তুমি চলে গেছ, শুধু কি আমরা তোমারি কাঙাল ভাই!
হারায়েছি গান, গোচরণ মাঠ, বাঁশের বাঁশরী তাই।
সোজাসুজি আজ উধাও চলিতে কোথা সে উধাও মাঠ,
গোখুর ধূলোয় চাঁদোয়া-টাঙানো কোথা সে গাঁয়ের বাট?
চরণ ফেলিতে চরণ চলে না শস্য-খেতের মানা,
খেলিবার মাঠে বড় জমকালো মিলেছে পাটের থানা।
গেঁয়ো শাখী আজ লুটায়ে পড়িছে কাঁচা পাকা ফল-ভারে,
তলে তলে তার মাঠের রাখাল হাট মিলাইতে নারে।
চষা মাঠে আজ লাঙল চলিতে জাগে না ভাটীর গান
সারা দিন খেটে অন্ন কুড়াই, তবু তাতে অকুলান।
ধানের গোলার গর্বেতে আজি ভরে না চাষীর বুক,
টিনের ঘরের আট-চালা বেঁধে রোদে জ্বলে পায় সুখ।
বাছের নায়েতে ছই দিয়ে চাষী পাটের বেপার করে,
দাবাড়ের গরু হালের খেতে যে জোয়াল বহিয়া মরে।
হেমন্ত নদী ঢেউ খেলেনাক সারীর গানের সুরে,
গরু-দৌড়ের মাঠখানি চাষী লাঙলেতে দেছে ফুঁড়ে।

মনে পড়ে ঘর ছোনের ছাউনি, বেড়িয়া চালের বাতা,
কৃষাণ বধূর বুকখানি যেন লাউ এর লতায় পাতা।
তারি পাশে পাশে প্রতি সন্ধ্যায় মাটির প্রদীপ ধরি
কুমারী মেয়েরা আশিস মাগিত গ্রাম-দেবতারে স্মরি।

আজকে সেখানে জ্বলে না প্রদীপ, বাজে না মাঠের গান,
ঘুমলী রাতের প্রহর গণিয়া জাগে না বিরহী প্রাণ।
শূনো বাড়িগুলো রয়েছে দাঁড়ায়ে, ফাটলে ফাটলে তার,
বুনো লতাগুলো জড়ায়ে জড়ায়ে গেঁথেছে বিরহ-হার।
উকুন যাহার গায়ে মারা যায়- থন থন করে তাজা,
এমন গরুরে পালিয়া কৃষাণ নিজেরে বনে না রাজা!
ধানের গোলার গর্ব ভুলেছে, ভুলেছে গায়ের বল,
চক্ষু বুজিয়া খুঁজিছে কোথায় টাকা বানানোর কল।

সারাদিন ভরি শুধু কাজ কাজ আরও চাই আরও-আরও-
ক্ষুধিত মানুষ ছুটিছে উধাও, তৃষ্ণা মেটে না কারও।
পেটে নাই ভাত, মুখে নাই হাসি, রোগে হাড়খানা সার,
প্রেত-পুরি যেন নামিয়া এসেছে বাহিয়া নরক-দ্বার।
হাজার কৃষাণ কাঁদিছে অঝোরে কোথা তুমি মহারাজ?
ব্রজের আকাশ ফাড়িয়া ফাড়িয়া হাঁকিছে বিরহ-বাজ।
আমরা তোমারে রাজা করেছিনু পাতার মুকুট গড়ে,
ছিঁড়ে ফেলে তাহা মণির মুকুট পরিলে কেমন করে?
বাঁশরী বাজায়ে শাসন করেছ মানুষ-পশুর দল,
সুর শুনে তার উজান বহিত কালো যমুনার জল।
কোন প্রাণে সেই বাঁশের বাঁশরী ভেঙে এলি গেঁয়ো বাটে?
কার লোভে তুই রাজা হলি ভাই! মথুরার রাজপাটে?
বাঁশীর শাসন হেলায় সয়েছি, বুনো ফলে দিছি কর,
অসির শাসন কি দিয়ে সহিব, বেচিয়াছি বাড়ি ঘর;
হালের গরুরে নিলামে দিয়েও মিটাতে পারিনি ভুখ,
আধখানা ফলে পেট ভরে যেত- ভেবে ভেবে হয় দুখ;
এত পেয়ে তোর সাধমেটেনাক, দুনিয়া জুড়িয়া ক্ষুধা,
আমরা রাখাল মাঠের কাঙাল যোগাইব তারি সুধা!

শোনরে কানাই! পষ্ট কহিছি, সহিব না মোরা আর,
সীমার বাহিরে সীমা আছে যদি, ধৈর্যেরো আছে বার।
ভাবিয়াছ ওই অসির শাসনে মোরা হয়ে জড়সড়,
নিজের ক্ষুধার অন্ন আনিয়া চরণে করিব জড়?

বাঁশীর শাসন মেনেছি বলিয়া অসিও মানিতে হবে!
শুরু দেয়া-ডাকে কাজরী গেয়েছি, ঝড়েও গাহিব তবে?
বাঁশীর শাসন বুকে যেয়ে লাগে, নত হয়ে আসে শির,
অসির শাসনে মরাদেরো মাঝে জেগে ওঠে শত বীর।
ভাবিয়াছ, মোরা গাঁয়ের রাখাল, নাই কোন হাতিয়ার,
যে লাঙল পারে মাটিরে ফাড়িতে, ভাঙিতেও পারে ঘাড়।
ঝড়ের সঙ্গে লড়িয়াছি মোরা, বাদলের সাথে যুঝি,
বর্ষার সাথে মিতালী পাতায়ে সোনা ধান করি পুঁজি।
* * *
তবুও সেখানে প্রদীপ জ্বালাই ঘন আঁধারের কোলে,
আঁকড়িয়া আছি পল্লীর মাটি কোন্ ক্ষমতার বলে!
জনমিয়া যারা দুখের নদীতে শিখিয়াছে দিতে পাড়ি,
অসির শাসন তরিবে তাহারা যাক না দুদিন চারি।
পষ্ট করিয়া কহিছি কানাই, এখন সময় আছে,
গাঁয়ে ফিরে চল, নতুবা তোমায় কাঁদিতে হইবে পাছে।
জনম-দুখিনী পল্লী-যশোদা আশায় রয়েচে বাঁচি,
পাতায় পাতায় লতায় লতায় লতিয়ে স্নেহের সাজি।
হিয়াখানি তার হানা-বাড়ি সম ফাটলে ফাটলে কাঁদি
বক্ষে লয়েছে তোমারি বিরহ বনের লতায় বাঁধি।

আঁধা পুকুরের পচা কালো জলে মুরছে কমল- রাধা,
কৃষাণ বধূরা সিনান করিতে শুনে যায় তারি কাঁদা।
বেনুবনে তুমি কবে বেঁধেছিলে তোমার বাঁশের বাঁশী,
দখিনা বাতাস আজিও তাহারে বাজাইয়া যায় আসি!
কোমল লতায় দোলনা বাঁধিয়া শাখীরা ডাকিছে সুরে,
আর কত কাল ভুলে রবি ভাই, পাষাণ মথুরা-পুরে?

আমরা ত ভাই! ভেবে পাইনাক তোরি বা কেমন রীত,
একলা বসিয়া কেতাব লিখিস ভুলিয়া মাঠের গীত।
পুঁথিগুলো সব পোড়াইয়া ফ্যাল, দেখে গাও করে জ্বালা,
কেমনে কাটাস সারাদিন তুই লইয়া ইহার পালা?
ওরাই তো তোরে যাদু করিয়াছে, মোরা যদি হইতাম,
ছিঁড়িয়া ছিঁড়িয়া বানাইয়া ঘুড়ির আকাশে উড়াইতাম!
রাজধানী যেরে পরদেশ তোর-ইট কাঠ দিয়ে ঘেরা,
ইট-কাঠ তাই আঁটঘাট বেঁধে মনেও কি দিলি বেড়া?

এত ডাক ডাকি শুনে ন শুনিস, এমনি কঠিন হিয়া-
আমরা রাখাল ভাবিয়া না পাই- গলাইব কিবা দিয়া?
একেলা আমরা মাঠে মাঠে ফিরি, পথে পথে কেঁদে মরি,
আমাদের গান শোনে নারে কেউ, লয়নাক হাত ধরি।
* * *
চল গাঁয়ে যাই, আঁকাবাঁকা পথ ধূলার দোলায় দোলে,
দুধারের খেত কাড়াকাড়ি করে তাহারে লইতে কোলে।
কদম্ব রেণু শিহরিয়া উঠে নতুন পাটল মেঘে,
তমালের বনে বিরহী রাধার ব্যথা-দেয়া যায় ডেকে।








যাব আমি তোমার দেশে
জসীম উদ্‌দীন---ধান ক্ষেত
পল্লী-দুলাল, যাব আমি-যাব আমি তোমার দেশে,
আকাশ যাহার বনের শীষে দিক-হারা মাঠ চরণ ঘেঁষে।
দূর দেশীয়া মেঘ-কনেরা মাথায় লয়ে জলের ঝারি,
দাঁড়ায় যাহার কোলটি ঘেঁষে বিজলী-পেড়ে আঁচল নাড়ি।
বেতস কেয়ার মাথায় যেথায় ডাহুক ডাকে বনের ছায়ায়,
পল্লী-দুলাল ভাইগো আমার, যাব আমি যাব সেথায়।

তোমার দেশে যাব আমি, দিঘল বাঁকা পন্থখানি,
ধান কাউনের খেতের ভেতর সরু সূতোর আঁচল টানি;
গিয়াছে হে হাবা মেয়ের এলোমাথার সিঁথীর মত
কোথাও সিধে, কোথায় বাঁকা, গরুর পায়ের রেখায় ক্ষত;
গাজনতলির মাঠ পেরিয়ে, শিমূলতলীর বনের বাঁয়ে,
কোথাও গায়ে রোদ মাখিয়া, ঘুম-ঘুমায়ে গাছের ছায়ে।
তাহার পরে মুঠি মুঠি ছড়িয়ে দিয়ে কদম-কলি,
কোথাও মেলে বনের লতা গ্রাম্য মেয়ে যায় যে চলি;
সে পথ দিয়ে যাব আমি পল্লী-দুলাল তোমার দেশে,
নাম-না জানা ফুলের সুবাস বাতাসেতে আসবে ভেসে।

তোমার দেশে যাব আমি, পাড়ার যত দস্যি ছেলে,
তাদের সাথে দল বাঁধিয়া হেথায় সেথায় ফিরব খেলে।
থল-দীঘিতে সাঁতার কেটে আনব তুলে রক্ত-কমল,
শাপলা লতায় জড়িয়ে চরণ ঢেউ এর সাথে খাব যে দোল।
হিজল ঝরা জলের সাথে গায়ের বরণ রঙিন হবে,
দীঘির জলে খেলবে লহর মোদের লীলাকালোসবে।

তোমার দেশে যাব আমি পল্লী-দুলাল ভাইগো সোনার,
সেথায় পথে ফেলতে চরণ লাগবে পরশ এই মাটি-মার!
ডাকব সেথা পাখির ডাকে, ভাব করিব শাখীর সনে,
অজান ফুলের রূপ দেখিয়া মানব তারে বিয়ের কনে;
চলতে পথে ময়না কাঁটায় উত্তরীয় জড়িয়ে যাবে,
অঢেল মাটির হোঁচট লেগে আঁচল হতে ফুল ছড়াবে।

পল্লী-দুলাল, যাব আমি-যাব আমি তোমার দেশে,
তোমার কাঁধে হাত রাখিয়া-ফিরবো মোরা উদাস বেশে।
বনের পাতার ফাঁকে ফাঁকে দেখব মোরা সাঁঝ বাগানে,
ফুল ফুটেছে হাজার রঙের মেঘ তুলিকার নিখুঁত টানে।
গাছের শাখা দুলিয়ে আমি পাড়ব সে ফুল মনের আশে,
উত্তরীয় ছড়িয়ে তুমি দাঁড়িয়ে থেকো বনের পাশে।

যে ঘাটেতে ভরবে কলস গাঁয়ের বিভোল পল্লীবালা,
সেই ঘাটেরি এক ধারেতে আসবো রেখে ফুলের মালা;
দীঘির জলে ঘট বুড়াতে পথে পাওয়া মালাখানি,
কুড়িয়ে নিয়ে ভাববে ইহা রাখিয়া গেছে কেউ না জানি।
চেনে না তার হাতের মালা হয়তবা সে পরবে গলে,
আমরা দুজন থাকব বসে ঢেউ দোলা সেই দীঘির কোলে।
চার পাশেতে বনের সারি এলিয়ে শাখার কুন্তল-ভার,
দীঘির জলে ঢেউ গণিবে ফুল শুঁকিবে পদ্ম-পাতার।
বনের মাঝে ডাকবে ডাহুক, ফিরবে ঘুঘু আপন বাসে,
দিনের পিদিম ঢুলবে ঘুমে রাত-জাগা কোন্ ফুলের বাসে।
চার ধারেতে বন জুড়িয়া রাতের আঁধার বাঁধবে বেড়া,
সেই কুহেলীর কালো কারায় দীঘির জলও পড়বে ঘেরা।
সেই আঁধারে পাখায় ধরে চামচিকারা উচ্চে উঠি,
দিকে দিকে দিগনে-রে ছড়িয়ে দেবে মুঠি মুঠি।
তখন সেথা থাকবে না কেউ, সুদূর বনের গহন কোণে,
কানাকুয়া ডাকবে শুধু পহরের পর পহর গণে।
সেই নিরালার বুকটি চিরে পল্লী দুলাল আমরা দুজন,
পল্লীমায়ের রূপটি যে কি, করব মোরা তার অন্বেষণ।








বামুন বাড়ির মেয়ে
জসীম উদ্‌দীন---ধান ক্ষেত
বামুন বাড়ির মেয়ে,
কাঁচা রোদের বরণ ঝরে গা-খানি তার বেয়ে-
সে রোদ দেখা যায়, যেমনি বনের পাতার ফাঁকে,
শিশু-রবির টুকরো আলো ছড়ায় ঝাঁকে ঝাঁকো;
তেমনি তাহার বসন বেয়ে, আঁচলখানি বেয়ে,
যে পথ দিয়ে চলে সে পথ রূপে যে যায় নেয়ে।

এই গাঁয়েতে আধলা পুকুর, পচা কাজল জল;
বেঙের ছাতি তাহার বুকে ভাসছে অবিরল।
সেখানেতে পানার বহর মশার দলের সনে,
চিরস্থায়ী ঘর বাঁধিয়া বাস করে নির্জনে।
তারির ফাঁকে বরষ বরষ জল-সাপলার পরী,
চাঁদের আলো মাখায় তাহার ফুলেল কুটীর ভরি।
সেই জলেরি ঢেউ বাঁধিয়া সূক্ষ্ম লতার সনে
কলমী-কুসুম নিতুই সাজে নতুন বিয়ের কনে।
সেখানেতে পদ্মপাতায় মেলি পূজার ফুল,
কলমিনী পুকুর জলে ভাসায় জাতি-কুল।
তেমনি এই সুদূর গাঁয়ে ম্যালেরিয়ার বাস,
ঝগড়া ফেসাদ-কুসংস্কার ঘুরছে চারি পাশ।
এরির মধ্যে বাস করে এই বামুন বাড়ির মেয়ে,
সবার সনে থেকেও সে যে একলা সবার চেয়ে।
ও যেন ঠিক কুমুদ-কুসুম দীঘির পচা জল,
আজও তাহার পায়নি ছুঁতে পরাগ শতদল।
ও যেন ঠিক ঝুমকো লতা জড়িয়ে গাঁয়ের সব,
হাসছে উহার পাতায় পাতায় ফুলে িমহোৎসব।

এই গাঁয়েতে বরষ বরষ আসছে মাহমারী,
হাজার পরাণ ধূলায় লোটে চরণ ঘায়ে তারি।
আসে হেথায় বসন্ত আর কলেরা প্লেগ আদি,
ওই মেয়েটির প্রতি এদের কেউ নাহি হয় বাদী।
সে যেন গাঁর পূজার কুসুম, সকল অত্যাচার,
সাহস নাহি পায় ছুঁইতে চরণ দুটি তার।

আছে গাঁয়ের নারদ-পিসী ক্ষান্ত মাসীর মাতা,
যাহার যত পোপন কিছু লিখছে ভরি খাতা।
আছে গাঁয়ে মোক্ষদা সে খ্যাংরামুখী বুড়ী;
মুখে কথার বজ্রশিলা ফিরছে ছুঁড়ি ছুঁড়ি।
ওই মেয়েটির জগৎ যেন তাদের হতে আর;
কিংবা তারা বুঝছে যে ও, নাগাল পাওয়ার বার।
ওই মেয়েটির চলন-চালন আর যে হাসি-খুশী,
কারো হাসি-খুশীর সনে হয়নি আজো দুষী।
এ গাঁয় প্রথম চাঁদ আসিয়া বসে শিমূল ডালে,
সোনা হাসির মুঠি মুঠি ছড়ায় উহার গালে।
সন্ধ্যা বেলায় যে রঙ ঝরে গাঁয়ের পুকুর জলে;
সেও হয়ত ওরির পায়ে আলতা মাখার ছলে।
গাঁয়ের মাঝে বামুন বাড়ি সকল বাড়ির সেরা;
চার ধারে তার নানান বরণ ফুল-বাগিচার বেড়া।
পাতায় পাতায় ফলের বাসা, ফুলের স্বপন মাঝে,
ফুলের চেয়েও ফুলেল সাজে বামুন বড়ি রাজে।

তাদের ঘরে ঠাকুর আছে মন্ত্র পড়ি রোজ
তুলসী তামা গঙ্গাজলে দেয় যে পূজার ভোজ।
সেথায় জ্বলে হোমের আগুন, ঘন্টা কাঁসর বাজে,
তাহার মাঝে বামুন বাড়ির পূজার ঠাকুর রাজে।
বামুন পাড়ার স্বপন যেন ধূপের ধোঁয়ায় হেসে,
পূজারতির মন্ত্র সনে বেড়ায ভেসে বেসে।
হোমাগুনের গন্ধ ঝরে সারাটি গাও বেয়ে
তারি মতন দাঁড়িয়ে হাসে বামুন বাড়ির মেয়ে।








পুরান পুকুর
জসীম উদ্‌দীন---ধান ক্ষেত
পুরান পুকুর, তব তীরে বসি ভাবিয়া উদাস হই,
খেজুরের গোড়ে বাঁধা ছোট ঘাট, করে জল থই থই;
রাত না পোহাতে গাঁয়ের বধুরা কলসীর কলরবে,
ঘুম হতে তোমা জাগাইয়া দিত প্রভাতের উৎসবে।
সারাদিন ধরি ঘড়ায় ঘড়ায় তব অমৃতরাশি,
বধুদের কাঁখে ঢলিয়া ঢলিয়া ঘরে ঘরে যেত হাসি।
‘বদনায়’ভরা একটুকু, তারি ভরসায় গেঁয়ো-চাষী,
চৈত্র-রোদের করুণ করিয়া বাজাত গানের বাঁশী।
মাঠ হতে তারা জ্বলিয়া পুড়িয়া আসিত তোমার তীরে,
খেজুর পাতায় সোনালী চামর দোলাতে তাদের শিরে।
শান্ত হইয়া গামছা ভিজায়ে তোমার কাজল-জলে,
নাহিয়া নাহিয়া সাধ মিটিত না-আবার নাহিবে বলে।

এইখানে বসি পল্লী-বধূরা আধেক ঘোমটা খুলি,
তোমার মুকুরে মুখখানি হেরে জল-ভরা যেত ভুলি।
সখিতে সখিতে কাঁধে কাঁধ ধরি খেলিত যে জল-খেলা,
সারাটি গাঁয়ের যত রূপ আছে তব বুকে হত মেলা,
পুকুরের জল উথলি পাথালি ভাসিত তাদের হাসি, -
ফুলে ফুল লাগি ফুলেরা যেমন ভেঙে হয় রাশি রাশি।
আজি মনে পড়ে, পুরান পুকুর, মায়ের আঁচল ধরে,
একটি ছেলের ঝাঁপাঝাঁপি খেলা তোমার বুকের পরে।
ওই এত জলে সাঁপলার ফুল, -তারি ছিল এত লোভ,
তাই তুলিবারে জলে ডুবিলেও মনে নাহি ছিল ক্ষোভ।
আজিকে তোমার কোথায় সে জল? কোথা সেই বাঁধা ঘাট,
গেঁয়ো বধূদের খাড়ুতে মুখর কোথা সে পুকুর বাট?

চারিধারে তব বন-জঙ্গল পাতায় পাতায় ঢাকা,
নিকষ-রাতের আঁধার যেন গো তুলিতে রয়েছে আঁকা।
ডুকরিয়া কাঁদে ডাহুক ডাহুকী তরু-মর্ম্মর স্বনে,
তারি সাথে বুঝি উঠিছে শিহরি যত ব্যথা তব মনে!
হিজল গাছের মালা হতে আজি খসিয়া রঙিন ফুল,
সাঁঝের মতন দিতেছে ব্যথিয়া তোমার চরণমূল।
সন্ধ্যা-সকালে আসিত যাহারা কলসী লইয়া ঘাটে,
তারা সবে আজি বিদায় নিয়েছে মরণ পারের হাটে।
বক্ষ-মুকুরে সোনা মুখখানি দেখিবারে কেহ নাই,
কুচুরী পানায় আধ বুকখানি ঢাকিয়া রেখেছ তাই!

ঘুচাও ঘুচাও মৌন তড়াগ, বুকের আরসীখানি,
মোর বাল্যের যত ভুলো-কথা সারা গায়ে দাও টানি।
সেই ছেলেবেলা স্বপ্নের মত কত স্নেহ ভরা মুখ,
এনে দাও, শুধু বারেক দেখিয়া ভরে লই সারা বুক।
এনে দাও সেই তব তীরে বসি মেঠো রাখালের বাঁশী
স্বপনের ভেলা দুলায়ে দুলায়ে আকাশেতে যাক্ ভাসি।
হায়রে, সেদিন আসে না ফিরিয়া! শুধু ভিজে আঁখি পাতা,
পুরানো স্বপন কুড়ায়ে কুড়ায়ে আকাশেতে জাল পাতা!
তুমিও সজনি, আমারি মতন না জানি কাঁদিছ কত,
ছোট ঢেউগুলি নাড়িয়া নাড়িয়া পাড়েরে করিছ ক্ষত।
বনদেবী আজ সমবেদনায় আঁচল বিছায়ে জলে,
ব্যথাতুরা তব সারা বুকখানি ঢেকেছে কলমী দলে।





পল্লী-বর্ষা
জসীম উদ্‌দীন---ধান ক্ষেত
আজিকের রোদ ঘুমায়ে পড়িয়া ঘোলাট-মেঘের আড়ে,
কেয়া-বন পথে স্বপন বুনিছে ছল ছল জল-ধারে।
কাহার ঝিয়ারী কদম্ব-শাখে নিঝ্ঝুম নিরালায়,
ছোট ছোট রেণু খুলিয়া দেখিছে অস্ফুট কলিকায়!
বাদলের জলে নাহিয়া সে মেয়ে হেসে কুটি কুটি হয়,
সে হাসি তাহার অধর নিঙাড়ি লুটাইছে বনময়।
কাননের পথে লহর খেলিছে অবিরাম জল-ধারা
তারি স্রোতে আজি শুকনো পাতারা ছুটিয়াছে ঘরছাড়া!
হিজলের বন ফুলের আখরে লিখিয়া রঙিন চিঠি,
নিরালা বাদলে ভাসায়ে দিয়েছে না জানি সে কোন দিঠি!
চিঠির উপরে চিঠি ভেসে যায় জনহীন বন বাটে,
না জানি তাহারা ভিড়িবে যাইয়া কার কেয়া-বন ঘাটে!
কোন্ সে বিরল বুনো ঝাউ শাখে বুনিয়া গোলাপী শাড়ী, -
হয়ত আজিও চেয়ে আছে পথে কানন-কুমার তারি!
দিকে দিগেনে- যতদূর চাহি, পাংশু মেঘের জাল
পায়ে জড়াইয়া পথে দাঁড়ায়েছে আজিকার মহাকাল।

গাঁয়ের চাষীরা মিলিয়াছে আসি মোড়লের দলিজায়, -
গল্পের গানে কি জাগাইতে চাহে আজিকার দিনটায়!
কেউ বসে বসে বাখারী চাঁচিছে, কেউ পাকাইছে রসি,
কেউবা নতুন দোয়াড়ীর গায়ে চাঁকা বাঁধে কসি কসি।
কেউ তুলিতেছে বাঁশের লাঠিতে সুন্দর করে ফুল
কেউবা গড়িছে সারিন্দা এক কাঠ কেটে নির্ভুল।
মাঝখানে বসে গাঁয়ের বৃদ্ধ, করুণ ভাটীর সুরে,
আমীর সাধুর কাহিনী কহিছে সারাটি দলিজা জুড়ে।

লাঠির উপরে, ফুলের উপরে আঁকা হইতেছে ফুল,
কঠিন কাঠ সে সারিন্দা হয়ে বাজিতেছে নির্ভুল।
তারি সাথে সাথে গল্প চলেছে- আমীর সাধুর নাও,
বহুদেশ ঘুরে আজিকে আবার ফিরিয়াছে নিজ গাঁও।
ডাব্বা হুঁকাও চলিয়াছে ছুটি এর হতে ওর হাতে,
নানান রকম রসি বুনানও হইতেছে তার সাথে।
বাহিরে নাচিছে ঝর ঝর জল, গুরু গুরু মেঘ ডাকে,
এ সবের মাঝে রূপ-কথা যেন আর রূপকথা আঁকে!
যেন ও বৃদ্ধ, গাঁয়ের চাষীরা, আর ওই রূপ-কথা,
বাদলের সাথে মিশিয়া গড়িছে আরেক কল্প-লতা।

বউদের আজ কোনো কাজ নাই, বেড়ায় বাঁধিয়া রসি,
সমুদ্রকলি শিকা বুনাইয়া নীরবে দেখিছে বসি।
কেউবা রঙিন কাঁথায় মেলিয়া বুকের স্বপনখানি,
তারে ভাষা দেয় দীঘল সূতার মায়াবী নকসা টানি।
বৈদেশী কোন্ বন্ধুর লাগি মন তার কেঁদে ফেরে,
মিঠে-সুরি-গান কাঁপিয়ে রঙিন ঠোঁটের বাঁধন ছেঁড়ে।

আজিকে বাহিরে শুধু ক্রন্দন ছল ছল জলধারে,
বেণু-বনে বায়ু নাড়ে এলোকেশ, মন যেন চায় কারে।








নিমন্ত্রণ
জসীম উদ্‌দীন---ধান ক্ষেত
তুমি যাবে ভাই – যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়,
গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়;
মায়া মমতায় জড়াজড়ি করি
মোর গেহখানি রহিয়াছে ভরি,
মায়ের বুকেতে, বোনের আদরে, ভাইয়ের স্নেহের ছায়,
তুমি যাবে ভাই – যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়,

ছোট গাঁওখানি- ছোট নদী চলে, তারি একপাশ দিয়া,
কালো জল তার মাজিয়াছে কেবা কাকের চক্ষু নিয়া;
ঘাটের কিনারে আছে বাঁধা তরী
পারের খবর টানাটানি করি;
বিনাসুতি মালা গাথিছে নিতুই এপার ওপার দিয়া;
বাঁকা ফাঁদ পেতে টানিয়া আনিছে দুইটি তটের হিয়া।

তুমি যাবে ভাই- যাবে মোর সাথে, ছোট সে কাজল গাঁয়,
গলাগলি ধরি কলা বন; যেন ঘিরিয়া রয়েছে তায়।
সরু পথ খানি সুতায় বাঁধিয়া
দূর পথিকেরে আনিছে টানিয়া,
বনের হাওয়ায়, গাছের ছায়ায়, ধরিয়া রাখিবে তায়,
বুকখানি তার ভরে দেবে বুঝি, মায়া আর মমতায়!

তুমি যাবে ভাই যাবে মোর সাথে – নরম ঘাসের পাতে
চম্বন রাখি অধরখানিতে মেজে লয়ো নিরালাতে।
তেলাকুচা – লতা গলায় পরিয়া
মেঠো ফুলে নিও আঁচল ভরিয়া,
হেথায় সেথায় ভাব করো তুমি বুনো পাখিদের সাথে,
তোমার গায়ের রংখানি তুমি দেখিবে তাদের পাতে।

তুমি যদি যাও আমাদের গাঁয়ে, তোমারে সঙ্গে করি
নদীর ওপারে চলে যাই তবে লইয়া ঘাটের তরী।
মাঠের যত না রাখাল ডাকিয়া
তোর সনে দেই মিতালী করিয়া
ঢেলা কুড়িইয়া গড়ি ইমারত সারা দিনমান ধরি,
সত্যিকারের নগর ভুলিয়া নকল নগর গড়ি।

তুমি যদি যাও – দেখিবে সেখানে মটর লতার সনে,
সীম আর সীম – হাত বাড়াইলে মুঠি ভরে সেই খানে।
তুমি যদি যাও সে – সব কুড়ায়ে
নাড়ার আগুনে পোড়ায়ে পোড়ায়ে,
খাব আর যত গেঁঢো – চাষীদের ডাকিয়া নিমন্ত্রণে,
হাসিয়া হাসিয়া মুঠি মুঠি তাহা বিলাইব দুইজনে।

তুমি যদি যাও – শালুক কুড়ায়ে, খুব – খুব বড় করে,
এমন একটি গাঁথিব মালা যা দেখনি কাহারো করে,
কারেও দেব না, তুমি যদি চাও
আচ্ছা না হয় দিয়ে দেব তাও,
মালাটিরে তুমি রাখিও কিন্তু শক্ত করিয়া ধরে,
ও পাড়াব সব দুষ্ট ছেলেরা নিতে পারে জোর করে;

সন্ধ্যা হইলে ঘরে ফিরে যাব, মা যদি বকিতে চায়,
মতলব কিছু আঁটির যাহাতে খুশী তারে করা যায়!
লাল আলোয়ানে ঘুঁটে কুড়াইয়া
বেঁধে নিয়ে যাব মাথায় করিয়া
এত ঘুষ পেয়ে যদি বা তাহার মন না উঠিতে চায়,
বলিব – কালিকে মটরের শাক এনে দেব বহু তায়।

খুব ভোর ক’রে উঠিতে হইবে, সূয্যি উঠারও আগে,
কারেও ক’বি না, দেখিস্ পায়ের শব্দে কেহ না জাগে
রেল সড়কের ছোট খাদ ভরে
ডানকিনে মাছ কিলবিল করে;
কাদার বাঁধন গাঁথি মাঝামাঝি জল সেঁচে আগে ভাগে
সব মাছগুলো কুড়ায়ে আনিব কাহারো জানার আগে।

ভর দুপুরেতে এক রাশ কাঁদা আর এক রাশ মাছ,
কাপড়ে জড়ায়ে ফিরিয়া আসিব আপন বাড়ির কাছ।
ওরে মুখ – পোড়া ওরে রে বাঁদর।
গালি – ভরা মার অমনি আদর,
কতদিন আমি শুনি নারে ভাই আমার মায়ের পাছ;
যাবি তুই ভাই, আমাদের গাঁয়ে যেথা ঘন কালো গাছ।

যাবি তুই ভাই, যাবি মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়।
ঘন কালো বন – মায়া মমতায় বেঁধেছে বনের বায়।
গাছের ছায়ায় বনের লতায়
মোর শিশুকাল লুকায়েছে হায়!
আজি সে – সব সরায়ে সরায়ে খুজিয়া লইব তায়,
যাবি তুই ভাই, যাবি মোর সাথে আমাদের ছোট গায়।

তোরে নিয়ে যাব আমাদের গাঁয়ে ঘন-পল্লব তলে
লুকায়ে থাকিস্, খুজে যেন কেহ পায় না কোনই বলে।
মেঠো কোন ফুল কুড়াইতে যেয়ে,
হারাইয়া যাস্ পথ নাহি পেয়ে;
অলস দেহটি মাটিতে বিছায়ে ঘুমাস সন্ধ্যা হলে,
সারা গাঁও আমি খুজিয়া ফিরিব তোরি নাম বলে বলে।








ধান ক্ষেত
জসীম উদ্‌দীন---ধান ক্ষেত
পথের কেনারে পাতা দোলাইয়া করে সদা সঙ্কেত,
সবুজে হদুদে সোহাগ ঢুলায়ে আমার ধানের ক্ষেত।
ছড়ায় ছড়ায় জড়াজড়ি করি বাতাসে ঢলিয়া পড়ে,
ঝাঁকে আর ঝাঁকে টিয়ে পাখিগুলে শুয়েছে মাঠের পরে।
কৃষাণ কনের বিয়ে হবে, তার হলদি কোটার শাড়ী,
হলুদে ছোপায় হেমন্ত রোজ কটি রোদ রেখা নাড়ি।
কলমী লতার গহনা তাহার গড়ার প্রতীক্ষায়,
ভিনদেশী বর আসা যাওয়া করে প্রভাত সাঁঝের নায়।

পথের কেনারে মোর ধান ক্ষেত, সবুজ পাতার পরে,
সোনার ছড়ায় হেমন্তরাণী সোনা হাসিখানি ধরে।
শরৎ সে কবে চরে গেছে তার সোনালী মেঘের ছটা,
আজো উড়িতেছে মোর এই খেতে ধরিয়া ধানের জটা।

মাঝে মাঝে এর পকিয়াছে ধান, কোনখানে পাকে নাই,
সকুজ শাড়ীর অঞ্চলে যেন ছোপ লাগিয়াছে তাই।
আজান গাঁয়ের কৃষাণকুমারী এইখান দিয়ে যেতে,
সোনার পায়ের চিহ্নগুলিরে গেছে এর বুকে পেতে।

মোর ধানক্ষেত, এইখানে এসে দাঁড়ালে উচচ শিরে,
মাথা যেন মোর ছুঁইবারে পারে সুদূর আকাশটিরে!
এইকানে এসে বুক ফুলাইয়া জোরে ডাক দিতে পারি,
হেথা আমি করি যা খুশী তাহাই, কারো নাহি ধার ধারি।
হেথায় নাহিক সমাজ-শাসন, নাহি প্রজা আর সাজা,
মোর ক্ষেত ভরি ফসলেরা নাচে, আমি তাহাদের রাজা।
এইখানে এসে দুঃখের কথা কহি তাহাদের সনে,
চৈত্র দিনের ভীষণ খরায় আষাঢ়ের বরিষণে।

কৃষাণী কনের কাঁকনের ঘায়ে ছিঁড়িয়া বুকের চাম,
এই ধানক্ষেত নয়নের জলে ভাসিয়েছি অবিরাম।
এইখানে বসে রাতের বেলায় বাঁশের বাঁশীর সুরে,
মোর ব্যথাখানি ছড়ায়েছি তার সুদূর কৃষাণ-পুরে।
এই ধানক্ষেত লুকাইয়া তার গোপন স্মৃতির চিন্,
দেখিয়া দেখিয়া কাটিয়া গিয়াছে কত না দীর্ঘদিন।

পথের কেনারে দাঁড়ায়ে রয়েছে আমার ধানের ক্ষেত,
আমার বুকের আশা-নিরাশার বেদনার সঙ্গেত।
বকের মেয়েরা গাঁথিয়া যতনে শ্বেত পালকের মালা,
চারিধারে এর ঘুরিয়া ঘুরিয়া সাজায় সোনার ডালা।
তাল বৃক্ষের উচু বাসা ছাড়ি বাবুই পাখির দল,
কিসের মায়ায় সারা ক্ষেত ভরি ফিরিতেছে চঞ্চল।
মাঝে মাঝে তারে জালে জড়াইয়া টেনে নিয়ে যেতে, চায়,
সকাল-সাঁঝের আলো-ছায়া-ঘেরা সোনালী তটের ছায়!
শিশির তাহারে মতির মালায় সাজায় সারাটি রাতি,
জোনাকীরা তার পাতায় পাতায় দোলায় তারার বাতি।






দিদারুল আলম স্মরণে
জসীম উদ্‌দীন---ধান ক্ষেত
খেলা না ভাঙিতে খেলা ছেড়ে গেলি কার ডাক শুনে ভাই,
এখনো যে তোর পূবালীর ঠোঁটে রঙ লেখা মুছে নাই!
আজো এই মাঠে বাঁশের বাঁশীতে বাজে যে মাঠের গান,
কালিন্দী-জল আজো দুলে ওঠে শুনিয়া মেয়ের শাড়ী,
মেছো বাঁশী শুনে আজো ঢেউ খেলে কাঁখের কলসে তারি।
কারে অভিমান করিয়া বন্ধু! ছেড়ে গেলি আমাদেরে,
এই ব্রজধামে আজো আসে নাই মথুরার দূত যে-রে।

কাঞ্চা বয়সে কে দিলরে তোরে আঙিয়ার শ্বেতবাস,
কোন দরবেশে তোর কানে কানে খুলিল মন্ত্রপাশ।
হায় মুসাফির, কে তোরে বাতাল গোরের কুহেলি পথ,
সেই একাকিয়া দূরে দেশে তুই ছাড়িলি জীবন-রথ।
অভিমানী ছেলে, কার চেয়েছিলি? কারে তুই পাস নাই?
কোন নিদাঘের নিঃশ্বাসে তোর ফুল শুকাইল ভাই?

ওরে বুলবুল, যারে শুনাইতে বেঁধেছিলি তুই গান,
সে ফুল-বনের কাঁটা দিয়ে কেউ বিঁধেছিল তোর প্রাণ/
তাই ছেড়ে গেলি-হায় পলাতক! শূণ্য পথের বাঁকে,
তোর গাঁথা গান আমাদের বুকে উভরিয়া আজ ডাকে।
আমাদের খেলা জমে না যে ভাই! তোর সে আদর ছাড়া,
আজি মনে হয়, কেউ নাহি জানে হেন মমতার ধারা।
একদিন মোরা ভুলে যাব তোরে, এ মায়ার দেশপরে,
কেউ কারো স্মৃতি চিরদিন ভরি রাখিতে পারে না ধরে।
তোর দেশে ভাই! হয়ত এমন মায়ার কুহক নাহি,
জীবনের গাঙে ঘটনার তরী যায় না এমন বাহি।
সেই দেশে তাই লিখে রাখিলাম আমাদের দিনগুলি,
এই খেলা-মাঠ, এই হাসি গান, যেন যাসনাক ভুলি।
রোজ কেয়ামতে যাদি দেখা হয়, বিস্ময়ে তব বুকে
হেরিব মোদের সকল কাহিনী স্পষ্ট রেখেছ টুকে।






চৌধুরীদের রথ
জসীম উদ্‌দীন---ধান ক্ষেত
চৌধুরীদের রথ
ডান ধারে তার ধূলায় ধূসর তালমা হাটের পথ।
চামচিকে আর আরসূলারা নির্ভাবনায় বসি,
করছে নানান কল-কোলাহল রথের মাঝে পশি!
বাদুর সেথা ঝুলছে সুখে, বাহির জগৎখানি,
অনেক দিনই ত্যাগ করেছে তাদের জানাজানি।
গরুর বীরের মাথায় বসি পাঁকুড় গাছের চারা,
মেলছে শিকড়, তবু ঠাকুর দেয়নি কোন সাড়া।
কাঠের ঘোড়ার ঠ্যাং ভেঙেছে, খসছে রথের ছাদ,
আজো তবু কেউ করেনি ইহার প্রতিবাদ।

রাস্তা দিয়ে নানান রকম লোকের চলাচল;
নানান রকম আলাপ বিলাপ, নানান কোলাহল।
কেউ বা চাষী, কেউ বা ধনী, পরদেশী, কেউ দেশী,
ভাবে তারা সবার চেয়ে কাজের কথাই বেশী।
কেউ বা ভাবে, মোকদমায় হারিয়ে দিয়ে কার
বসত-বাড়ি করবে নিলাম বাঁশ-গাড়ীতে তার।
কেউ বা ভাবে, কি কৌশলে মেলি কথার জাল,
এক আনিতে আনবে টেনে ছয়পয়সার মাল।
যতই কেন ব্যস্ত থাকুক, যতই কাজের তাড়া;
হেথায় এলে সব ভুলে চায় রথের পানে তারা।
চাক ভাঙা আর বয়স মলিন চৌধুরীদের রথ,
তাদের পানে করুন চেয়ে শুধায় যেন পথ;-
শুধায় যেন, সেই অতীতের চৌধুরীদের কে,
ছুতোর ডেকে রঙিন এ রথ গড়লপুলকে!
আসল গাঁয়ের বৃদ্ধ পোটো, রঙিন তুলির সনে,
রেখায় রেখায় বাঁধল সে কোন সোনার স্বপনে।
রথের চূড়ায় উড়ল ধ্বজা, গাঁয়ের ছেলে-মেয়ে,
চলতে পথে থাকত খানিক রথের পানে চেয়ে।

তারপরে সে রথের দিনে হাজার লোকের মেলা,
দোকান পসার, ভোজবাজী আর ভানুমতীর খেলা,
আসত গাঁয়ের বৌ ঝিরা সব, আসত ছেলে-মেয়ে,
রঙিন হাসির দুলত লহর রঙিন কাপড় ছেয়ে।
বুড়ো মাসীর স্কন্ধে উঠে ছোট্ট শিশু ছেলে;
এই রথেরি ঠাকুরটিরে দেখত আঁখি মেলে।
গাঁর বধূরা ভালের সিদুর মেলে পথের পরে
সরল বুকের আঁকত পূজা এই ঠাকুরের তরে।
আঁচল তাদের জড়িয়ে ধরে ছোট্ট শিশুর দল,
তালের পাতার বাজিয়ে বাঁশী করত কোলাহল।
দৌড়ের নাও ভাসত গাঙে, রঙিন নিশান লয়ে,
গলুই ভরি জ্বলত পিতল নব-রতন হয়ে।
তাহার গলে পরিয়ে দিত রঙিন সোলার মালা,
এমনি মত হাজার নায়ে গাঙটি হত আলা।
সেই নায়েতে বাছ খেলাত গাঁয়ের যত চাষী;
বৈঠা পরে বৈঠা হাঁকি চলত তারা ভাসি।
তারি তালে গাইত তারা ভাটির সুরে গান,
শুনে নদী উথল পাথাল, ঢেউ ভেঙে খান খান।
কৌতুহলী দাঁড়িয়ে তীরে হাজার নয়-নারী,
হাতে তাদের দুলত মালা গলায় দিতে তারি,
যাহার তরী সব তরীরে পেরিয়ে যাবে আগে,
তারে তারা করবে বরণ মনের অনুরাগে।

সে সব আজি কোথায় গেল, চৌধুরীদের রথ,
আজো যেন শুধায় সবে তাদের চলা-পথ।
চাকাগুলো ভেঙেছে তার উই ধরেছে কাঠে,
কোন অভিযোগ বক্ষে লয়ে সময় তাদের কাটে!
ছবিগুলো যাচ্ছে মুছে, ভাঙা কদম ডাল,
ত্যাগ করিয়া পালিয়ে গেছে নিঠুর বংশীয়াল।
তলায় বসে একলা রাধা কাঁপছে পুলকে,
জানতে আজো পায়নি তাহার বন্ধু নিল কে।
মাঠের পথে চলছে ধেনু বিরাম নাহি হ্যয়,
রাখাল কবে ঠ্যাং ভেঙেছে, কেউ না ফিরে চায়।
দল বাঁধিয়া চলছে কোথায় গাঁয়ের ছেলে-মেয়ে,
মৃদঙ্গ আর ঢোল বাঁজায়ে বাঁশীতে গান গেয়ে।
হয়ত কোন পরব গাঁয়ের করবে সমাপন,
হাজার বরষ আগেই তাহার করছে আয়োজন।
কারো কাঁধের ঢোল ভেঙেছে কাহারো একতারা,
দলপতি যে নেইক সাথে, টের পায়নি তারা।
এমনি কালের কঠোর ঘায়ে দিনের পরে দিন,
এ সব ছবির একখানিকরও থাকবেনাক চিন।
এর সাথে সেই গাঁয়ের পোটো, -তাহার কথাও সবে,
ভুলে যাবে অজানা কোন দিনের মহোৎসবে।
কোন সে অতীত আঁধার সাগর, তাহারপারে বসি,
এঁকেছিল সোনার স্বপন বরণ ঘষি ঘষি।
হয়ত তারি গাঁয়ের যত নর-নারীর দল,
মনে তাহার ফুটিয়েছিল স্বপন শতদল;
তারি একটি সোনার কলি আলোক- তরীর প্রায়,
সপ্ত সাগর পার হইয়া ভিড়ছে রথের গায়!
আজ হয়ত অনাদরেই অনেক অভিমানে,
চলছে ফিরে প্রদীপ তরী সেই অতীতের পানে;
সেখানে সেই বৃদ্ধ পোটো বনস্পতির প্রায়,
হাজার শাখা এলিয়ে বায়ে ঢুলছে নিরালায়।
চাক ভাঙা আর বয়স মিলন চৌধুরীদের রথ,
আজো যেন চক্ষু মুদে খুঁজছে তাদের পথ।
বনের লতায় গা ছেয়েছে, গাছের শাখা তারে,
জড়িয়ে ধরে এ সব কথা শুনছে বারে বারে।









কৃষাণী দুই মেয়ে
জসীম উদ্‌দীন---ধান ক্ষেত
কৃষাণী দুই মেয়ে
পথের কোণে দাঁড়িয়ে হাসে আমার পানে চেয়ে।
ওরা যেন হাসি খুশীর দুইটি রাঙা বোন,
হাসি-খুশীর বেসাত ওরা করছে সারাখন।
ঝাকড়া মাথায় কোঁকড়া চুলে, লেগেছে খড়কুটো,
তাহার নীচে মুখ দুখানি যেন তরমুজফালি দুটো।
সেই মুখেতে কে দুখানি তরমুজেরি ফালি,
একটি মেয়ে লাজুক বড়, মুখর আরেক জন,
লজ্জাবতীর লতা যেন জড়িয়ে গোলাপ বন।

একটি হাসে, আর সে হাসি লুকায় আঁচল কোণে,
রাঙা মুখের খুশী মিলায় রাঙা শাড়ীর সনে।
পউষ-রবির হাসির মত আরেক জনের হাসি,
কুয়াশাহীন আকাশ ভরে টুকরো-মেঘে ভাসি।
চাষীদের ওই দুইটি মেয়ে ঈদের দুটি চাঁদ,
যেই দেখেছি, পেরিয়ে গেল নয়নপুরীর ফাঁদ।


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সমাস H S C ছাত্র -ছাত্রীদের জন্য।

পারিভাষিক শব্দ

কবি জসীম উদ্দিন