(ক্ষণিকা) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (৮ই মে, ১৮৬১ - ৭ই আগস্ট, ১৯৪১) (২৫ বৈশাখ, ১২৬৮ - ২২ শ্রাবণ, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ) ছিলেন অগ্রণী বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিক। তাঁকে বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক মনে করা হয়। রবীন্দ্রনাথকে গুরুদেব, কবিগুরু ও বিশ্বকবি অভিধায় ভূষিত করা হয়।
রবীন্দ্রনাথের ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস ও ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন তাঁর জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর অব্যবহিত পরে প্রকাশিত হয়। তাঁর সর্বমোট ৯৫টি ছোটগল্প ও ১৯১৫টি গান যথাক্রমে গল্পগুচ্ছ ও গীতবিতান সংকলনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় প্রকাশিত ও গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত রচনা ৩২ খণ্ডে রবীন্দ্র রচনাবলী নামে প্রকাশিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় পত্রসাহিত্য উনিশ খণ্ডে চিঠিপত্র ও চারটি পৃথক গ্রন্থে প্রকাশিত। এছাড়া তিনি প্রায় দুই হাজার ছবি এঁকেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের রচনা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতার এক ধনাঢ্য ও সংস্কৃতিবান ব্রাহ্ম পিরালী ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যকালে প্রথাগত বিদ্যালয়-শিক্ষা তিনি গ্রহণ করেননি; গৃহশিক্ষক রেখে বাড়িতেই তাঁর শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৮৭৪ সালে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা-এ তাঁর "অভিলাষ" কবিতাটি প্রকাশিত হয়। এটিই ছিল তাঁর প্রথম প্রকাশিত রচনা।
১৮৭৮ সালে মাত্র সতেরো বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ প্রথমবার ইংল্যান্ডে যান। ১৮৮৩ সালে মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। ১৮৯০ সাল থেকে রবীন্দ্রনাথ পূর্ববঙ্গের শিলাইদহের জমিদারি এস্টেটে বসবাস শুরু করেন। ১৯০১ সালে তিনি পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেখানেই পাকাপাকিভাবে বসবাস শুরু করেন।[২৩] ১৯০২ সালে তাঁর পত্নীবিয়োগ হয়। ১৯০৫ সালে তিনি বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯১৫ সালে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে নাইট উপাধিতে ভূষিত করেন। কিন্তু ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি সেই উপাধি ত্যাগ করেন। ১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য তিনি শ্রীনিকেতন নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠিত হয়। দীর্ঘজীবনে তিনি বহুবার বিদেশ ভ্রমণ করেন এবং সমগ্র বিশ্বে বিশ্বভ্রাতৃত্বের বাণী প্রচার করেন। ১৯৪১ সালে দীর্ঘ রোগভোগের পর কলকাতার পৈত্রিক বাসভবনেই তাঁর মৃত্যু হয়।
রবীন্দ্রনাথের ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস ও ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন তাঁর জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর অব্যবহিত পরে প্রকাশিত হয়। তাঁর সর্বমোট ৯৫টি ছোটগল্প ও ১৯১৫টি গান যথাক্রমে গল্পগুচ্ছ ও গীতবিতান সংকলনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় প্রকাশিত ও গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত রচনা ৩২ খণ্ডে রবীন্দ্র রচনাবলী নামে প্রকাশিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় পত্রসাহিত্য উনিশ খণ্ডে চিঠিপত্র ও চারটি পৃথক গ্রন্থে প্রকাশিত। এছাড়া তিনি প্রায় দুই হাজার ছবি এঁকেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের রচনা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতার এক ধনাঢ্য ও সংস্কৃতিবান ব্রাহ্ম পিরালী ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যকালে প্রথাগত বিদ্যালয়-শিক্ষা তিনি গ্রহণ করেননি; গৃহশিক্ষক রেখে বাড়িতেই তাঁর শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৮৭৪ সালে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা-এ তাঁর "অভিলাষ" কবিতাটি প্রকাশিত হয়। এটিই ছিল তাঁর প্রথম প্রকাশিত রচনা।
১৮৭৮ সালে মাত্র সতেরো বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ প্রথমবার ইংল্যান্ডে যান। ১৮৮৩ সালে মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। ১৮৯০ সাল থেকে রবীন্দ্রনাথ পূর্ববঙ্গের শিলাইদহের জমিদারি এস্টেটে বসবাস শুরু করেন। ১৯০১ সালে তিনি পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেখানেই পাকাপাকিভাবে বসবাস শুরু করেন।[২৩] ১৯০২ সালে তাঁর পত্নীবিয়োগ হয়। ১৯০৫ সালে তিনি বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯১৫ সালে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে নাইট উপাধিতে ভূষিত করেন। কিন্তু ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি সেই উপাধি ত্যাগ করেন। ১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য তিনি শ্রীনিকেতন নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠিত হয়। দীর্ঘজীবনে তিনি বহুবার বিদেশ ভ্রমণ করেন এবং সমগ্র বিশ্বে বিশ্বভ্রাতৃত্বের বাণী প্রচার করেন। ১৯৪১ সালে দীর্ঘ রোগভোগের পর কলকাতার পৈত্রিক বাসভবনেই তাঁর মৃত্যু হয়।
ভাঙা হাটে কে ছুটেছিস , পসরা লয়ে ? সন্ধ্যা হল , ওই - যে বেলা গেল রে বয়ে । যে যার বোঝা মাথার ' পরে ফিরে এল আপন ঘরে , একাদশীর খণ্ড শশী উঠল পল্লীশিরে । পারের গ্রামে যারা থাকে উচ্চকণ্ঠে নৌকা ডাকে , হাহা করে প্রতিধ্বনি নদীর তীরে তীরে । কিসের আশে ঊর্ধ্বশ্বাসে এমন সময়ে ভাঙা হাটে তুই ছুটেছিস পসরা লয়ে ? সুপ্তি দিল বনের শিরে হস্ত বুলায়ে , কা কা ধ্বনি থেমে গেল কাকের কুলায়ে । বেড়ার ধারে পুকুর - পাড়ে ঝিল্লি ডাকে ঝোপে ঝাড়ে , বাতাস ধীরে পড়ে এল , স্তব্ধ বাঁশের শাখা— হেরো ঘরের আঙিনাতে শ্রান্তজনে শয়ন পাতে , সন্ধ্যাপ্রদীপ আলোক ঢালে বিরাম - সুধা - মাখা । সকল চেষ্টা শান্ত যখন এমন সময়ে ভাঙা হাটে কে ছুটেছিস , পসরা লয়ে ?
কেউ যে কারে চিনি নাকো সেটা মস্ত বাঁচন । তা না হলে নাচিয়ে দিত বিষম তুর্কি - নাচন । বুকের মধ্যে মনটা থাকে , মনের মধ্যে চিন্তা— সেইখানেতেই নিজের ডিমে সদাই তিনি দিন তা । বাইরে যা পাই সম্জে নেব তারি আইন - কানুন , অন্তরেতে যা আছে তা অন্তর্যামীই জানুন । চাই নে রে , মন চাই নে । মুখের মধ্যে যেটুকু পাই যে হাসি আর যে কথাটাই যে কলা আর যে ছলনাই তাই নে রে মন , তাই নে । বাইরে থাকুক মধুর মূর্তি , সুধামুখের হাস্য , তরল চোখে সরল দৃষ্টি— করব না তার ভাষ্য । বাহু যদি তেমন করে জড়ায় বাহুবন্ধ আমি দুটি চক্ষু মুদে রইব হয়ে অন্ধ— কে যাবে ভাই , মনের মধ্যে মনের কথা ধরতে ? কীটের খোঁজে কে দেবে হাত কেউটে সাপের গর্তে ? চাই নে রে , মন চাই নে । মুখের মধ্যে যেটুকু পাই যে হাসি আর যে কথাটাই যে কলা আর যে ছলনাই তাই নে রে মন , তাই নে । মন নিয়ে কেউ বাঁচে নাকো , মন বলে যা পায় রে কোনো জন্মে মন সেটা নয় জানে না কেউ হায় রে । ওটা কেবল কথার কথা , মন কি কেহ চিনিস ? আছে কারও আপন হাতে মন ব'লে এক জিনিস ? চলেন তিনি গোপন চালে , স্বাধীন তাঁহার ইচ্ছে— কেই বা তাঁরে দিচ্ছে এবং কেই বা তাঁরে নিচ্ছে ! চাই নে রে , মন চাই নে । মুখের মধ্যে যেটুকু পাই যে হাসি আর যে কথাটাই যে কলা আর যে ছলনাই তাই নে রে মন , তাই নে ।
ওই শোনো গো , অতিথ বুঝি আজ এল আজ । ওগো বধূ , রাখো তোমার কাজ রাখো কাজ । শুনছ না কি তোমার গৃহদ্বারে রিনিঠিনি শিকলটি কে নাড়ে , এমন ভরা সাঁঝ ! পায়ে পায়ে বাজিয়ো নাকো মল , ছুটো নাকো চরণ চঞ্চল , হঠাৎ পাবে লাজ । ওই শোনো গো , অতিথ এল আজ এল আজ । ওগো বধূ , রাখো তোমার কাজ রাখো কাজ । নয় গো কভু বাতাস এ নয় নয় কভু নয় । ওগো বধূ , মিছে কিসের ভয় মিছে ভয় ! আঁধার কিছু নাইকো আঙিনাতে , আজকে দেখো ফাগুন - পূর্ণিমাতে আকাশ আলোময় । নাহয় তুমি মাথার ঘোমটা টানি হাতে নিয়ো ঘরের প্রদীপখানি , যদি শঙ্কা হয় । নয় গো কভু বাতাস এ নয় নয় কভু নয় । ওগো বধূ মিছে কিসের ভয় মিছে ভয় ! নাহয় কথা কোয়ো না তার সনে পান্থ - সনে । দাঁড়িয়ে তুমি থেকো একটি কোণে দুয়ার - কোণে । প্রশ্ন যদি শুধায় কোনো - কিছু নীরব থেকো মুখটি করে নীচু নম্র দু - নয়নে । কাঁকন যেন ঝংকারে না হাতে , পথ দেখিয়ে আনবে যবে সাথে অতিথিসজ্জনে । নাহয় কথা কোয়ো না তার সনে পান্থ - সনে । দাঁড়িয়ে তুমি থেকো একটি কোণে দুয়ার - কোণে । ওগো বধূ , হয় নি তোমার কাজ গৃহ - কাজ ? ওই শোনো কে অতিথ এল আজ এল আজ । সাজাও নি কি পূজারতির ডালা ? এখনো কি হয় নি প্রদীপ জ্বালা গোষ্ঠগৃহের মাঝ ? অতি যত্নে সীমান্তটি চিরে সিঁদুর - বিন্দু আঁক নাই কি শিরে ? হয় নি সন্ধ্যাসাজ ? ওগো বধূ , হয় নি তোমার কাজ গৃহ - কাজ ? ওই শোনো কে অতিথ এল আজ এল আজ ।
আজ বসন্তে বিশ্বখাতায় হিসেব নেইকো পুষ্পে পাতায় , জগৎ যেন ঝোঁকের মাথায় সকল কথাই বাড়িয়ে বলে । ভুলিয়ে দিয়ে সত্যি মিথ্যে , ঘুলিয়ে দিয়ে নিত্যানিত্যে , দু ধারে সব উদারচিত্তে বিধিবিধান ছাড়িয়ে চলে । আমারো দ্বার মুক্ত পেয়ে সাধুবুদ্ধি বহির্গতা , আজকে আমি কোনোমতেই বলব নাকো সত্য কথা । প্রিয়ার পুণ্যে হলেম রে আজ একটা রাতের রাজ্যাধিরাজ , ভাণ্ডারে আজ করছে বিরাজ সকল প্রকার অজস্রত্ব । কেন রাখব কথার ওজন ? কৃপণতায় কোন্ প্রয়োজন ? ছুটুক বাণী যোজন যোজন উড়িয়ে দিয়ে ষত্ব ণত্ব । চিত্তদুয়ার মুক্ত ক'রে সাধুবুদ্ধি বহির্গতা , আজকে আমি কোনোমতেই বলব নাকো সত্য কথা । হে প্রেয়সী স্বর্গদূতী , আমার যত কাব্যপুঁথি তোমার পায়ে পড়ে স্তুতি , তোমারি নাম বেড়ায় রটি ; থাকো হৃদয় - পদ্মটিতে এক দেবতা আমার চিতে— চাই নে তোমায় খবর দিতে আরো আছেন তিরিশ কোটি । চিত্তদুয়ার মুক্ত ক'রে সাধুবুদ্ধি বহির্গতা , আজকে আমি কোনোমতেই বলব নাকো সত্য কথা । ত্রিভুবনে সবার বাড়া একলা তুমি সুধার ধারা , উষার ভালে একটি তারা , এ জীবনে একটি আলো— সন্ধ্যাতারা ছিলেন কে কে সে - সব কথা যাব ঢেকে , সময় বুঝে মানুষ দেখে তুচ্ছ কথা ভোলাই ভালো । চিত্তদুয়ার মুক্ত রেখে সাধুবুদ্ধি বহির্গতা , আজকে আমি কোনোমতেই বলব নাকো সত্য কথা । সত্য থাকুন ধরিত্রীতে শুষ্ক রুক্ষ ঋষির চিতে , জ্যামিতি আর বীজগণিতে , কারো ইথে আপত্তি নেই— কিন্তু আমার প্রিয়ার কানে এবং আমার কবির গানে পঞ্চশরের পুষ্পবাণে মিথ্যে থাকুন রাত্রিদিনেই । চিত্তদুয়ার মুক্ত রেখে সাধুবুদ্ধি বহির্গতা , আজকে আমি কোনোমতেই বলব নাকো সত্য কথা । ওগো সত্য বেঁটেখাটো , বীণার তন্ত্রী যতই ছাঁটো , কণ্ঠ আমার যতই আঁটো , বলব তবু উচ্চ সুরে— আমার প্রিয়ার মুগ্ধ দৃষ্টি করছে ভুবন নূতন সৃষ্টি , মুচকি হাসির সুধার বৃষ্টি চলছে আজি জগৎ জুড়ে । চিত্তদুয়ার মুক্ত রেখে সাধুবুদ্ধি বহির্গতা , আজকে আমি কোনোমতেই বলব নাকো সত্য কথা । যদি বল ‘ আর বছরে এই কথাটাই এমনি করে বলেছিলি , কিন্তু ওরে শুনেছিলেন আরেক জনে'— জেনো তবে মূঢ়মত্ত , আর বসন্তে সেটাই সত্য , এবারো সেই প্রাচীন তত্ত্ব ফুটল নূতন চোখের কোণে । চিত্তদুয়ার মুক্ত রেখে সাধুবুদ্ধি বহির্গতা , আজকে আমি কোনোমতেই বলব নাকো সত্য কথা । আজ বসন্তে বকুল ফুলে যে গান বায়ু বেড়ায় বুলে কাল সকালে যাবে ভুলে— কোথায় বাতাস, কোথায় সে ফুল ! হে সুন্দরী , তেমনি কবে এ - সব কথা ভুলব যবে মনে রেখো আমায় তবে— ক্ষমা কোরো আমার সে ভুল । চিত্তদুয়ার মুক্ত রেখে সাধুবুদ্ধি বহির্গতা , আজকে আমি কোনোমতেই বলব নাকো সত্য কথা ।
ছেড়ে গেলে হে চঞ্চলা , হে পুরাতন সহচরী ! ইচ্ছা বটে বছর কতক তোমার জন্য বিলাপ করি , সোনার স্মৃতি গড়িয়ে তোমার বসিয়ে রাখি চিত্ততলে , একলা ঘরে সাজাই তোমায় মাল্য গেঁথে অশ্রুজলে— নিদেন কাঁদি মাসেক - খানেক তোমায় চির - আপন জেনেই— হায় রে আমার হতভাগ্য ! সময় যে নেই , সময় যে নেই । বর্ষে বর্ষে বয়স কাটে , বসন্ত যায় কথায় কথায় , বকুলগুলো দেখতে দেখতে ঝ'রে পড়ে যথায় তথায় , মাসের মধ্যে বারেক এসে অস্তে পালায় পূর্ণ - ইন্দু , শাস্ত্রে শাসায় জীবন শুধু পদ্মপত্রে শিশিরবিন্দু— তাঁদের পানে তাকাব না তোমায় শুধু আপন জেনেই সেটা বড়োই বর্বরতা— সময় যে নেই , সময় যে নেই । এসো আমার শ্রাবণ - নিশি , এসো আমার শরৎলক্ষ্মী , এসো আমার বসন্তদিন লয়ে তোমার পুষ্পপক্ষী , তুমি এসো , তুমিও এসো , তুমি এসো , এবং তুমি , প্রিয়ে , তোমরা সবাই জান ধরণীর নাম মর্তভূমি— যে যায় চলে বিরাগভরে তারেই শুধু আপন জেনেই বিলাপ করে কাটাই , এমন সময় যে নেই , সময় যে নেই । ইচ্ছে করে বসে বসে পদ্যে লিখি গৃহকোণায় ‘ তুমিই আছ জগৎ জুড়ে'— সেটা কিন্তু মিথ্যে শোনায় । ইচ্ছে করে কোনোমতেই সান্ত্বনা আর মান্ব না রে , এমন সময় নতুন আঁখি তাকায় আমার গৃহদ্বারে— চক্ষু মুছে দুয়ার খুলি তারেই শুধু আপন জেনেই , কখন তবে বিলাপ করি ? সময় যে নেই , সময় যে নেই ।
আমি যে তোমায় জানি , সে তো কেউ জানে না । তুমি মোর পানে চাও , সে তো কেউ মানে না । মোর মুখে পেলে তোমার আভাস কত জনে কত করে পরিহাস , পাছে সে না পারি সহিতে নানা ছলে তাই ডাকি যে তোমায়— কেহ কিছু নারে কহিতে । তোমার পথ যে তুমি চিনায়েছ সে কথা বলি নে কাহারে । সবাই ঘুমালে জনহীন রাতে একা আসি তব দুয়ারে । স্তব্ধ তোমার উদার আলয় , বীণাটি বাজাতে মনে করি ভয় , চেয়ে থাকি শুধু নীরবে । চকিতে তোমার ছায়া দেখি যদি ফিরে আসি তব গরবে । প্রভাত না হতে কখন আবার গৃহকোণ - মাঝে আসিয়া বাতায়নে বসি বিহ্বল বীণা বিজনে বাজাই হাসিয়া । পথ দিয়ে যে বা আসে যে বা যায় সহসা থমকি চমকিয়া চায় , মনে করে তারে ডেকেছি— জানে না তো কেহ কত নাম দিয়ে এক নামখানি ঢেকেছি । ভোরের গোলাপ সে গানে সহসা সাড়া দেয় ফুলকাননে , ভোরের তারাটি সে গানে জাগিয়া চেয়ে দেখে মোর আননে । সব সংসার কাছে আসে ঘিরে , প্রিয়জন সুখে ভাসে আঁখিনীরে , হাসি জেগে ওঠে ভবনে । যে নামে যে ছলে বীণাটি বাজাই সাড়া পাই সারা ভুবনে । নিশীথে নিশীথে বিপুল প্রাসাদে তোমার মহলে মহলে হাজার হাজার সোনার প্রদীপ জ্বলে অচপল অনলে । মোর দীপে জ্বেলে তাহারি আলোক পথ দিয়ে আসি , হাসে কত লোক , দূরে যেতে হয় পালায়ে— তাই তো সে শিখা ভবনশিখরে পারি নে রাখিতে জ্বালায়ে । বলি নে তো কারে , সকালে বিকালে তোমার পথের মাঝেতে বাঁশি বুকে লয়ে বিনা কাজে আসি বেড়াই ছদ্মসাজেতে । যাহা মুখে আসে গাই সেই গান নানা রাগিণীতে দিয়ে নানা তান , এক গান রাখি গোপনে । নানা মুখপানে আঁখি মেলি চাই , তোমা - পানে চাই স্বপনে ।
যতবার আজ গাঁথনু মালা পড়ল খসে খসে কী জানি কার দোষে ! তুমি হোথায় চোখের কোণে দেখছ বসে বসে । চোখ - দুটিরে প্রিয়ে , শুধাও শপথ নিয়ে আঙুল আমার আকুল হল কাহার দৃষ্টিদোষে ! আজ যে বসে গান শোনাব কথাই নাহি জোটে , কণ্ঠ নাহি ফোটে । মধুর হাসি খেলে তোমার চতুর রাঙা ঠোঁটে । কেন এমন ত্রুটি বলুক আঁখি - দুটি— কেন আমার রুদ্ধ কণ্ঠে কথাই নাহি ফোটে ! রেখে দিলাম মাল্য বীণা , সন্ধ্যা হয়ে আসে । ছুটি দাও এ দাসে— সকল কথা বন্ধ করে বসি পায়ের পাশে । নীরব ওষ্ঠ দিয়ে পারব যে কাজ প্রিয়ে এমন কোনো কর্ম দেহো অকর্মণ্য দাসে ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন