জীবনানন্দ দাশ
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ

জীবনানন্দ দাশ (জন্ম: ১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৯, বরিশাল - মৃত্যু: ২২ অক্টোবর, ১৯৫৪, বঙ্গাব্দ: ৬ ফাল্গুন, ১৩০৫ - ৫ কার্তিক, ১৩৬১) বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাংলা কবি।
তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অগ্রগণ্য। মৃত্যুর পর থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর শেষ ধাপে তিনি জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেন এবং ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে যখন তাঁর জন্মশতবার্ষিকী পালিত হচ্ছিল ততদিনে তিনি বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয়তম কবিতে পরিণত হয়েছেন।
জীবনানন্দের সাহিত্যিক জীবন বিকশিত হতে শুরু করে। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ১৯২৫ এর জুনে মৃত্যুবরণ করলে জীবনানন্দ তার স্মরণে 'দেশবন্ধুর প্রয়াণে' নামক একটি কবিতা রচনা করেন, যা বঙ্গবাণী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। কবিতাটি পরবর্তীতে তার প্রথম কাব্য সংকলন ঝরা পালকে স্থান করে নেয়। কবিতাটি পড়ে কবি কালিদাস রায় মন্তব্য করেছিলেন, "এ কবিতাটি নিশ্চয়ই কোন প্রতিষ্ঠিত কবির ছদ্মনামে রচনা"। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দেই তার প্রথম প্রবন্ধ স্বর্গীয় কালীমোহন দাশের শ্রাদ্ধবাসরে প্রবন্ধটি ব্রাহ্মবাদী পত্রিকার পরপর তিনটি সংখ্যায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। ঐ বছরেই কল্লোল পত্রিকায় 'নীলিমা' কবিতাটি প্রকাশিত হলে তা অনেক তরুণ কাব্যসরিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ধীরে ধীরে কলকাতা, ঢাকা এবং অন্যান্য জায়গার বিভিন্ন সাহিত্যপত্রিকায় তার লেখা ছাপা হতে থাকে; যার মধ্যে রয়েছে সে সময়কার সুবিখ্যাত পত্রিকা কল্লোল, কালি ও কলম, প্রগতি প্রভৃতি। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ঝরা পালক প্রকাশিত হয়। সে সময় থেকেই তিনি তার উপাধি 'দাশগুপ্তের' বদলে কেবল 'দাশ' লিখতে শুরু করেন।
সম্ভবতঃ মা কুসুমকুমারী দেবীর প্রভাবেই ছেলেবেলায় পদ্য লিখতে শুরু করেন তিনি। ১৯১৯ সালে তাঁর লেখা একটি কবিতা প্রকাশিত হয়। এটিই তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতা। কবিতাটির নাম বর্ষা আবাহন। এটি ব্রহ্মবাদী পত্রিকার ১৩২৬ সনের বৈশাখ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। তখন তিনি শ্রী জীবনানন্দ দাশগুপ্ত নামে লিখতেন। ১৯২৭ সাল থেকে তিনি জীবনানন্দ দাশ নামে লিখতে শুরু করেন। ১৬ জুন ১৯২৫ দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ এর লোকান্তর হলে তিনি 'দেশবন্ধুর প্রয়াণে' শিরোনামে একটি কবিতা লিখেছিলেন যা বংগবাণী পত্রিকার ১৩৩২ সনের শ্রাবণ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। তবে দীনেশরঞ্জন দাস সম্পাদিত কল্লোল পত্রিকায় ১৩৩২ (১৯২৬ খ্রি.) ফাল্গুন সংখ্যায় তাঁর নীলিমা শীর্ষক কবিতাটি প্রকাশিত হলে আধুনিক বাংলা কবিতার ভুবনে তার অন্নপ্রাশন হয়। জীবদ্দশায় তাঁর ৭টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। প্রথম প্রকাশিত ঝরাপালক শীর্ষক কাব্যগ্রন্থে তাঁর প্রকৃত কবিত্বশক্তি ফুটে ওঠেনি, বরং এতে কবি কাজী নজরুল ইসলাম, মোহিতলাল মজুমদার ও সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের প্রকট প্রভাব প্রত্যক্ষ হয়। তবে দ্রুত তিনি স্বকীয়তা অর্জন করেছিলেন। দীর্ঘ ব্যবধানে প্রকাশিত দ্বিতীয় কাব্য সংকলন ধূসর পান্ডুলিপি-তে তাঁর স্বকীয় কাব্য কৌশল পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। বাংলা সাহিত্যের ভূবনে তাঁর বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। শেষের দিককার কবিতায় অর্থনির্মলতার অভাব ছিল। সাতটি তারার তিমির প্রকাশিত হওয়ার পর তার বিরুদ্ধে দুবোর্ধ্যতার অভিযোগ ওঠে। নিজ কবিতার অপমূল্যায়ন নিয়ে জীবনানন্দ খুব ভাবিত ছিলেন। তিনি নিজেই স্বীয় রচনার অর্থায়ন করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলেন যদিও শেষাবধি তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তবে কবি নিজেই নিজ রচনার কড়া সমালোচক ছিলেন। তাই সাড়ে আট শত কবিতার বেশী কবিতা লিখলেও তিনি জীবদ্দশায় মাত্র ২৬২টি কবিতা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ও কাব্যসংকলনে প্রকাশ করতে দিয়েছিলেন। এমনকি রূপসী বাংলার সম্পূর্ণ প্রস্তুত পাণ্ডুলিপি তোড়ঙ্গে মজুদ থাকলেও তা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি জীবনানন্দ দাশ। তবে তিনি এ কাব্যগ্রন্থটির নাম দিয়েছিলেন বাংলার ত্রস্ত নীলিমা যা তার মৃত্যুর পর আবিষ্কৃত এবং রূপসী বাংলা প্রচ্ছদনামে প্রকাশিত হয়। আরেকটি পাণ্ডুলিপি আবিষ্কৃত হয় মৃত্যু পরবর্তীকালে যা বেলা অবেলা কালবেলা নামে প্রকাশিত হয়। জীবদ্দশায় তার একমাত্র পরিচয় ছিল কবি। অর্থের প্রয়োজনে তিনি কিছু প্রবন্ধ লিখেছিলেন ও প্রকাশ করেছিলেন। তবে নিভৃতে গল্প এবং উপন্যাস লিখেছিলেন প্রচুর যার একটিও প্রকাশের ব্যবস্থা নেননি। এছাড়া ষাট-পয়ষট্টিরও বেশী খাতায় "লিটেরেরী নোটস" লিখেছিলেন যার অধিকাংশ এখনও (২০০৯) প্রকাশিত হয়নি।
নিখিলবঙ্গ রবীন্দ্রসাহিত্য সম্মেলন ১৯৫২ খৃস্টাব্দে পরিবর্ধিত সিগনেট সংস্করণ বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থটি বাংলা ১৩৫৯-এর শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ বিবেচনায় পুরস্কৃত করা হয়। কবির মৃত্যুর পর ১৯৫৫ খৃস্টাব্দের ফেব্রুয়ারী মাসে জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৪) সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করে।
কাব্যগ্রন্থ
জীবনানন্দের কাব্যগ্রন্থসমূহের প্রকাশকাল সম্পর্কে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য যে, কয়েকটি কাব্যগ্রন্থের একাধিক পরিবর্ধিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল। নিচে কেবল প্রথম প্রকাশনার বৎসর উল্লিখিত। মৃত্যু পরবর্তী প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ তারকা চিহ্নিত।
ঝরা পালক (১৯২৭)
ধূসর পান্ডুলিপি (১৯৩৬)
বনলতা সেন (১৯৪২, কবিতাভবন সংস্করণ)
মহাপৃথিবী (১৯৪৪)
সাতটি তারার তিমির (১৯৪৮)
বনলতা সেন (১৯৫২, সিগনেট প্রেস সংস্করণ)
জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৪)
রূপসী বাংলা (১৯৫৭)*
বেলা অবেলা কালবেলা (১৯৬১)*
সুদর্শনা (১৯৭৪)*
আলো পৃথিবী (১৯৮১) *
মনোবিহঙ্গম*
তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অগ্রগণ্য। মৃত্যুর পর থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর শেষ ধাপে তিনি জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেন এবং ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে যখন তাঁর জন্মশতবার্ষিকী পালিত হচ্ছিল ততদিনে তিনি বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয়তম কবিতে পরিণত হয়েছেন।
জীবনানন্দের সাহিত্যিক জীবন বিকশিত হতে শুরু করে। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ১৯২৫ এর জুনে মৃত্যুবরণ করলে জীবনানন্দ তার স্মরণে 'দেশবন্ধুর প্রয়াণে' নামক একটি কবিতা রচনা করেন, যা বঙ্গবাণী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। কবিতাটি পরবর্তীতে তার প্রথম কাব্য সংকলন ঝরা পালকে স্থান করে নেয়। কবিতাটি পড়ে কবি কালিদাস রায় মন্তব্য করেছিলেন, "এ কবিতাটি নিশ্চয়ই কোন প্রতিষ্ঠিত কবির ছদ্মনামে রচনা"। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দেই তার প্রথম প্রবন্ধ স্বর্গীয় কালীমোহন দাশের শ্রাদ্ধবাসরে প্রবন্ধটি ব্রাহ্মবাদী পত্রিকার পরপর তিনটি সংখ্যায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। ঐ বছরেই কল্লোল পত্রিকায় 'নীলিমা' কবিতাটি প্রকাশিত হলে তা অনেক তরুণ কাব্যসরিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ধীরে ধীরে কলকাতা, ঢাকা এবং অন্যান্য জায়গার বিভিন্ন সাহিত্যপত্রিকায় তার লেখা ছাপা হতে থাকে; যার মধ্যে রয়েছে সে সময়কার সুবিখ্যাত পত্রিকা কল্লোল, কালি ও কলম, প্রগতি প্রভৃতি। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ঝরা পালক প্রকাশিত হয়। সে সময় থেকেই তিনি তার উপাধি 'দাশগুপ্তের' বদলে কেবল 'দাশ' লিখতে শুরু করেন।
সম্ভবতঃ মা কুসুমকুমারী দেবীর প্রভাবেই ছেলেবেলায় পদ্য লিখতে শুরু করেন তিনি। ১৯১৯ সালে তাঁর লেখা একটি কবিতা প্রকাশিত হয়। এটিই তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতা। কবিতাটির নাম বর্ষা আবাহন। এটি ব্রহ্মবাদী পত্রিকার ১৩২৬ সনের বৈশাখ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। তখন তিনি শ্রী জীবনানন্দ দাশগুপ্ত নামে লিখতেন। ১৯২৭ সাল থেকে তিনি জীবনানন্দ দাশ নামে লিখতে শুরু করেন। ১৬ জুন ১৯২৫ দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ এর লোকান্তর হলে তিনি 'দেশবন্ধুর প্রয়াণে' শিরোনামে একটি কবিতা লিখেছিলেন যা বংগবাণী পত্রিকার ১৩৩২ সনের শ্রাবণ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। তবে দীনেশরঞ্জন দাস সম্পাদিত কল্লোল পত্রিকায় ১৩৩২ (১৯২৬ খ্রি.) ফাল্গুন সংখ্যায় তাঁর নীলিমা শীর্ষক কবিতাটি প্রকাশিত হলে আধুনিক বাংলা কবিতার ভুবনে তার অন্নপ্রাশন হয়। জীবদ্দশায় তাঁর ৭টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। প্রথম প্রকাশিত ঝরাপালক শীর্ষক কাব্যগ্রন্থে তাঁর প্রকৃত কবিত্বশক্তি ফুটে ওঠেনি, বরং এতে কবি কাজী নজরুল ইসলাম, মোহিতলাল মজুমদার ও সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের প্রকট প্রভাব প্রত্যক্ষ হয়। তবে দ্রুত তিনি স্বকীয়তা অর্জন করেছিলেন। দীর্ঘ ব্যবধানে প্রকাশিত দ্বিতীয় কাব্য সংকলন ধূসর পান্ডুলিপি-তে তাঁর স্বকীয় কাব্য কৌশল পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। বাংলা সাহিত্যের ভূবনে তাঁর বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। শেষের দিককার কবিতায় অর্থনির্মলতার অভাব ছিল। সাতটি তারার তিমির প্রকাশিত হওয়ার পর তার বিরুদ্ধে দুবোর্ধ্যতার অভিযোগ ওঠে। নিজ কবিতার অপমূল্যায়ন নিয়ে জীবনানন্দ খুব ভাবিত ছিলেন। তিনি নিজেই স্বীয় রচনার অর্থায়ন করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলেন যদিও শেষাবধি তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তবে কবি নিজেই নিজ রচনার কড়া সমালোচক ছিলেন। তাই সাড়ে আট শত কবিতার বেশী কবিতা লিখলেও তিনি জীবদ্দশায় মাত্র ২৬২টি কবিতা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ও কাব্যসংকলনে প্রকাশ করতে দিয়েছিলেন। এমনকি রূপসী বাংলার সম্পূর্ণ প্রস্তুত পাণ্ডুলিপি তোড়ঙ্গে মজুদ থাকলেও তা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি জীবনানন্দ দাশ। তবে তিনি এ কাব্যগ্রন্থটির নাম দিয়েছিলেন বাংলার ত্রস্ত নীলিমা যা তার মৃত্যুর পর আবিষ্কৃত এবং রূপসী বাংলা প্রচ্ছদনামে প্রকাশিত হয়। আরেকটি পাণ্ডুলিপি আবিষ্কৃত হয় মৃত্যু পরবর্তীকালে যা বেলা অবেলা কালবেলা নামে প্রকাশিত হয়। জীবদ্দশায় তার একমাত্র পরিচয় ছিল কবি। অর্থের প্রয়োজনে তিনি কিছু প্রবন্ধ লিখেছিলেন ও প্রকাশ করেছিলেন। তবে নিভৃতে গল্প এবং উপন্যাস লিখেছিলেন প্রচুর যার একটিও প্রকাশের ব্যবস্থা নেননি। এছাড়া ষাট-পয়ষট্টিরও বেশী খাতায় "লিটেরেরী নোটস" লিখেছিলেন যার অধিকাংশ এখনও (২০০৯) প্রকাশিত হয়নি।
নিখিলবঙ্গ রবীন্দ্রসাহিত্য সম্মেলন ১৯৫২ খৃস্টাব্দে পরিবর্ধিত সিগনেট সংস্করণ বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থটি বাংলা ১৩৫৯-এর শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ বিবেচনায় পুরস্কৃত করা হয়। কবির মৃত্যুর পর ১৯৫৫ খৃস্টাব্দের ফেব্রুয়ারী মাসে জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৪) সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করে।
কাব্যগ্রন্থ
জীবনানন্দের কাব্যগ্রন্থসমূহের প্রকাশকাল সম্পর্কে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য যে, কয়েকটি কাব্যগ্রন্থের একাধিক পরিবর্ধিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল। নিচে কেবল প্রথম প্রকাশনার বৎসর উল্লিখিত। মৃত্যু পরবর্তী প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ তারকা চিহ্নিত।
ঝরা পালক (১৯২৭)
ধূসর পান্ডুলিপি (১৯৩৬)
বনলতা সেন (১৯৪২, কবিতাভবন সংস্করণ)
মহাপৃথিবী (১৯৪৪)
সাতটি তারার তিমির (১৯৪৮)
বনলতা সেন (১৯৫২, সিগনেট প্রেস সংস্করণ)
জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৪)
রূপসী বাংলা (১৯৫৭)*
বেলা অবেলা কালবেলা (১৯৬১)*
সুদর্শনা (১৯৭৪)*
আলো পৃথিবী (১৯৮১) *
মনোবিহঙ্গম*
পথহাঁটা
- জীবনানন্দ দাশ---বনলতা সেন
কী এক ইশারা যেন মনে রেখে একা একা শহরের পথ থেকে পথে
অনেক হেঁটেছি আমি; অনেক দেখেছি আমি ট্রাম-বাস সব ঠিক চলে;
তারপর পথ ছেড়ে শান্ত হয়ে চলে যায় তাহাদের ঘুমের জগতে:
সারারাত গ্যাস লাইট আপনার কাজ বুঝে ভালো করে জ্বলে।
কেউ ভুল করে নাকো-ইঁট বাড়ি সাইনবোর্ড জানালা কপাট ছাদ সব
চুপ হয়ে ঘুমাবার প্রয়োজন বোধ করে আকাশের তলে।
একা একা পথ হেঁটে এদের গভীর শান্তি হৃদয়ে করেছি অনুভব;
তখন অনেক রাত-তখন অনেক তারা মনুমেন্ট মিনারের মাথা
নির্জনে ঘিরেছে এসে;-মনে হয় কোনোদিন এর চেয়ে সহজ সম্ভব
আর কিছু দেখেছি কি: একরাশ তারা আর মনুমেন্ট ভরা কলকাতা?
চোখ নিচে নেমে যায়-চুরুট নীরবে জ্বলে-বাতাসে অনেক ধুলো খড়;
চোখ বুজে একপাশে সরে যাই-গাছ থেকে অনেক বাদামি জীর্ণ পাতা
উড়ে গেছে; বেবিলনে একা একা এমনই হেঁটেছি আমি রাতের ভিতর
কেন যেন; আজো আমি জানি নাকো হাজার হাজার ব্যস্ত বছরের পর।
অঘ্রান প্রান্তরে
- জীবনানন্দ দাশ---বনলতা সেন
‘জানি আমি তোমার দু’চোখ আজ আমাকে খোঁজে না
আর পৃথিবীর’ পরে-’
বলে চুপে থামলাম, কেবলি অশত্থ পাতা পড়ে আছে ঘাসের ভিতরে
শুকনো মিয়োনো ছেঁড়া;- অঘ্রান এসেছে আজ পৃথিবীর বনে;
সে সবের ঢের আগে আমাদের দুজনের মনে
হেমন্ত এসেছে তবু; বললে সে, ‘ঘাসের ওপরে সব বিছানো পাতার
মুখে এই নিস্তব্ধতা কেমন যে-সন্ধ্যার আবছা অন্ধকার
ছড়িয়ে পড়েছে জলে’; কিছুক্ষণ অঘ্রাণের অস্পষ্ট জগতে
হাঁটলাম, চিল উড়ে চলে গেছে-কুয়াশার প্রান্তরের পথে
দুএকটা সজারুর আসা-যাওয়া; উচ্ছল কলার ঝাড়ে উড়ে
চুপে সন্ধ্যার বাতাসে
লক্ষ্মীপেঁচা হিজলের ফাঁক দিয়ে বাবলার আঁধার গলিতে নেমে আসে;
আমাদের জীবনের অনেক অতীত ব্যাপ্তি আজো যেন
লেগে আছে বহতা পাখায়
ওইসব পাখিদের; ওইসব দূর দূর ধানক্ষেতে, ছাতকুড়ো-মাখা
ক্লান্ত জামের শাখায়;
নীলচে ঘাসের ফুলে ফড়িঙের হৃদয়ের মতো নীরবতা
ছড়িয়ে রয়েছে এই প্রান্তরে বুকে আজ ...হেঁটে চলি... আজ কোনো কথা
নেই আর আমাদের; মাঠের কিনারে ঢের ঝরা ঝাউফল
পড়ে আছে; খড়কুটো উড়ে এসে লেগে আছে শড়ির ভিতরে,
সজনে পাতার গুঁড়ি চুলে বেঁধে গিয়ে নড়েচড়ে;
পতঙ্গ পালক্ জল-চারিদিকে সূর্যের উজ্জ্বলতা নাশ;
আলেয়ার মতো ওই ধানগুলো নড়ে শূন্যে কী রকম অবাধ আকাশ
হয়ে যায়; সময়ও অপার-তাকে প্রেম আশা চেতনার কণা
ধরে আছে বলে সে-ও সনাতন;-কিন্তু এই ব্যর্থ ধারণা
সরিয়ে মেয়েটি তাঁর আঁচলের চোরাকাঁটা বেছে
প্রান্তর নক্ষত্র নদী আকাশের থেকে সরে গেছে
যেই স্পষ্ট নির্লিপ্তিতে-তাই-ই ঠিক;-ওখানে সিগ্ধ হয় সব।
সুচেতনা
- জীবনানন্দ দাশ---বনলতা সেন
সুচেতনা, তুমি এক দূরতর দ্বীপ
বিকেলের নক্ষত্রের কাছে;
সেইখানে দারুচিনি-বনানীর ফাঁকে
নির্জনতা আছে।
এই পৃথিবীর রণ রক্ত সফলতা
সত্য; তবু শেষ সত্য নয়।
কলকাতা একদিন কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে;
তবুও তোমার কাছে আমার হৃদয়।
আজকে অনেক রূঢ় রৌদ্রের ঘুরে প্রাণ
পৃথিবীর মানুষকে মানুষের মতো
ভালোবাসা দিতে গিয়ে তবু,
দেখেছি আমারি হাতে হয়তো নিহত
ভাই বোন বন্ধু পরিজন পড়ে আছে;
পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন;
মানুষ তবুও ঋণী পৃথিবীরই কাছে।
কেবলি জাহাজ এসে আমাদের বন্দরের রোদে
দেখেছি ফসল নিয়ে উপনীত হয়;
সেই শস্য অগণন মানুষের শব;
শব থেকে উৎসারিত স্বর্ণের বিস্ময়
আমাদের পিতা বুদ্ধ কনফুশিয়াসের মতো আমাদেরো প্রাণ
মূক করে রাখে; তবু চারিদকে রক্তক্লান্ত কাজের আহ্বান।
সুচেতনা, এই পথে আলো জ্বেলে — এ পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে;
সে অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ;
এ বাতাস কী পরম সূর্যকরোজ্জ্বল;–
প্রায় তত দূর ভালো মানবসমাজ
আমাদের মতো ক্লান্ত ক্লান্তিহীন নাবিকের হাতে
গড়ে দেব আজ নয়, ঢের দূর অন্তিম প্রভাতে।
মাটি-পৃথিবীর টানে মানবজন্মের ঘরে কখন এসেছি,
না এলেই ভালো হত অনুভব করে;
এসে যে গভীরতর লাভ হল সে সব বুঝেছি
শিশির শরীর ছুঁয়ে সমুজ্জ্বল ভোরে;
দেখেছি যা হল হবে মানুষের যা হবার নয়–
শাশ্বত রাত্রির বুকে সকলি অনন্ত সূর্যোদয়।
সবিতা
- জীবনানন্দ দাশ---বনলতা সেন
সবিতা, মানুষজন্ম আমরা পেয়েছি
মনে হয় কোনো এক বসন্তের রাতে:
ভূমধ্যসাগর ঘিরে সেই সব জাতি,
তাহাদের সাথে
সিন্ধুর আঁধার পথে করেছি গুঞ্জন;
মনে পড়ে নিবিড় মেরুন আলো, মুক্তার শিকারী,
রেশম, মদের সার্থবাহ,
দুধের মতন শাদা নারী।
অন্তত রৌদ্রের থেকে তারা
শাশ্বত রাত্রির দিকে তবে
সহসা বিকেলবেলা শেষ হয়ে গেলে
চলে যেত কেমন নীরবে।
চারি দিকে ছায়া ঘুম সপ্তর্ষি নক্ষত্র;
মধ্যযুগের অবসান
স্থির করে দিতে গিয়ে ইউরোপ গ্রীস
হতেছে উজ্জ্বল খৃষ্টান।
তবুও অতীত থেকে উঠে এসে তুমি আমি ওরা–
সিন্ধুর রাত্রির জল জানে–
আধেক যেতাম নব পৃথিবীর দিকে;
কেমন অনন্যোপায় হাওয়ার আহ্বানে
আমরা অকূল হয়ে উঠে
মানুষকে মানুষের প্রয়াসকে শ্রদ্ধা করা হবে
জেনে তবু পৃথিবীর মৃত সভ্যতায়
যেতাম তো সাগরের স্নিগ্ধ কলরবে।
এখন অপর আলো পৃথিবীতে জ্বলে;
কী এক অপব্যয়ী অক্লান্ত আগুন!
তোমার নিবিড় কালো চুলের ভিতরে
কবেকার সমুদ্রের নুন;
তোমার মুখের রেখা আজো
মৃত কত পৌত্তলিক খৃষ্টান সিন্ধুর
অন্ধকার থেকে এসে নব সূর্যে জাগার মতন;
কত আছে — তবু কত দূরে।
মিতাভাষণ
- জীবনানন্দ দাশ---বনলতা সেন
তোমার সৌন্দর্য নারী, অতীতের দানের মতন।
মধ্যসাগরের কালো তরঙ্গের থেকে
ধর্মাশোকের স্পষ্ট আহ্বানের মতো
আমাদের নিয়ে যায় ডেকে
শান্তির সঙ্ঘের দিকে — ধর্মে — নির্বাণে;
তোমার মুখের স্নিগ্ধ প্রতিভার পানে।
অনেক সমুদ্র ঘুরে ক্ষয়ে অন্ধকারে
দেখেছি মণিকা-আলো হাতে নিয়ে তুমি
সময়ের শতকের মৃত্যু হলে তবু
দাঁড়িয়ে রয়েছে শ্রেয়তর বেলাভূমি:
যা হয়েছে যা হতেছে এখুনি যা হবে
তার স্নিগ্ধ মালতী-সৌরভে।
মানুষের সভ্যতার মর্মে ক্লান্তি আসে;
বড়ো বড়ো নগরীর বুকভরা ব্যথা;
ক্রমেই হারিয়ে ফেলে তারা সব সঙ্কল্প স্বপ্নের
উদ্যমের অমূল্য স্পষ্টতা।
তবুও নদীর মানে স্নিগ্ধ শুশ্রূষার জল, সূর্য মানে আলো :
এখনো নারী মানে তুমি, কত রাধিকা ফুরালো।
সুরঞ্জনা
- জীবনানন্দ দাশ---বনলতা সেন
সুরঞ্জনা, আজো তুমি আমাদের পৃথিবীতে আছ;
পৃথিবীর বয়সিনী তুমি এক মেয়ের মতন;
কালো চোখ মেলে ওই নীলিমা দেখেছ;
গ্রীক হিন্দু ফিনিশিয় নিয়মের রূঢ় আয়োজন
শুনেছ ফেনিল শব্দে তিলোত্তমা-নগরীরর গায়ে
কী চেয়েছে? কী পেয়েছে ?— গিয়েছে হারায়ে।
বয়স বেড়েছে ঢের নরনারীদের,
ঈষৎ নিভেছে সূর্য নক্ষত্রের আলো;
তবুও সমুদ্র নীল: ঝিনুকের গায়ে আলপনা;
একটি পাখির গান কী রকম ভালো।
মানুষ কাউকে চায় — তার সেই নিহত উজ্জ্বল
ঈশ্বরের পরিবর্তে অন্য কোন সাধনার ফল।
মনে পড়ে কবে এক তারাভরা রাতের বাতাসে
ধর্মাশোকের ছেলে মহেন্দ্রের সাথে
উতরোল বড়ো সাগরের পথে অন্তিম আকাঙ্ক্ষা নিয়ে প্রাণে
তবুও কাউকে আমি পারিনি বোঝাতে
সেই ইচ্ছা সঙ্ঘ নয় শক্তি নয় কর্মীদের সুধীদের বিবর্ণতা নয়,
আরো আলো: মানুষের তরে এক মানুষীর গভীর হৃদয়।
যেন সব অন্ধকার সমুদ্রের ক্লান্ত নাবিকেরা।
মক্ষিকার গুঞ্জনের মতো এক বিহ্বল বাতাসে
ভূমধ্যসারলীন দূর এক সভ্যতার থেকে
আজকের নব সভ্যতায় ফিরে আসে;–
তুমি সেই অপরূপ সিন্ধু রাত্রি মৃতদের রোল
দেহ দিয়ে ভালোবেসে, তবু আজ ভোরের কল্লোল।
হাজার বছর শুধু খেলা করে
- জীবনানন্দ দাশ---বনলতা সেন
হাজার বছর শুধু খেলা করে অন্ধকারে জোনাকির মতো;
চারিদিকে চিরদিন রাত্রির নিধান;
বালির উপরে জ্যোৎস্না — দেবদারু ছায়া ইতস্তত
বিচূর্ণ থামের মতো: দ্বারকার; — দাঁড়ায়ে রয়েছে নত, ম্লান।
শরীরে ঘুমের ঘ্রাণ আমাদের ঘুচে — গেছে জীবনের সব লেনদেন;
‘মনে আছে?’ শুধালো সে — শুধালাম আমি শুধু, ‘বনলতা সেন?’
শিরীষের ডালপালা
- জীবনানন্দ দাশ---বনলতা সেন
শিরীষের ডালপালা লেগে আছে বিকেলের মেঘে,
পিপুলের ভরা বুকে চিল নেমে এসেছে এখন;
বিকেলের শিশুসুর্যকে ঘিরে মায়ের আবেগে
করুণ হয়েছে ঝাউবন।
নদীর উজ্জ্বল জল কোরালের মতো কলবরে
ভেসে নারকোলবনে কেড়ে নেয় কোরালীর ভ্রূণ;
বিকেল বলেছে এই নদীটিকে: ‘শান্ত হতে হবে–’
অকূল সুপুরিবন স্থির জলে ছায়া ফেলে এক মাইল শান্তি কল্যাণ
হয়ে আছে। তার মুখ মনে পড়ে এ-রকম স্নিগ্ধ পৃথিবীর
পাতাপতঙ্গের কাছে চলে এসে; চারিদিকে রাত্রি নক্ষত্রের আলোড়ন
এখন দয়ার মতো; তবুও দয়ার মানে মৃত্যুতে স্থির
হয়ে থেকে ভুলে যাওয়া মানুষের সনাতন মন।
ধান কাটা হয়ে গেছে
- জীবনানন্দ দাশ---বনলতা সেন
ধান কাটা হয়ে গেছে কবে যেন — ক্ষেত মাঠে পড়ে আছে খড়
পাতা কুটো ভাঙা ডিম — সাপের খোলস নীড় শীত।
এই সব উৎরায়ে ওইখানে মাঠের ভিতর
ঘুমাতেছে কয়েকটি পরিচিত লোক আজ — কেমন নিবিড়।
ওইখানে একজন শুয়ে আছে — দিনরাত দেখা হত কত কত দিন
হৃদয়ের খেলা নিয়ে তার কাছে করেছি যে কত অপরাধ;
শান্তি তবু: গভীর সবুজ ঘাস ঘাসের ফড়িং
আজ ঢেকে আছে তার চিন্তা আর জিজ্ঞাসার অন্ধকার স্বাদ।
তুমি
- জীবনানন্দ দাশ---বনলতা সেন
নক্ষত্রের চলাফেরা ইশারায় চারিদিকে উজ্জ্বল আকাশ;
বাতাসে নীলাভ হয়ে আসে যেন প্রান্তরের ঘাস;
কাঁচপোকা ঘুমিয়েছে — গঙ্গাফড়িং সে-ও ঘুমে;
আম নিম হিজলের ব্যাপ্তিতে পড়ে আছ তুমি।
‘মাটির অনেক নীচে চলে গেছ? কিংবা দূর আকাশের পারে
তুমি আজ? কোন্ কথা ভাবছ আধারে?
ওই যে ওখানে পায়রা একা ডাকে জামিরের বনে;
মনে হয় তুমি যেন ওই পাখি-তুমি ছাড়া সময়ের এ-উদ্ভাবনে
আমার এমন কাছে — আশ্বিনের এত বড় অকূল আকাশে
আর কাকে পাব এই সহজ গভীর অনায়াসে –’
বলতেই নিখিলের অন্ধকার দরকারে পাখি গেল উড়ে
প্রকৃতিস্থ প্রকৃতির মতো শব্দে — প্রেম অপ্রেম থেকে দূরে।
আমাকে তুমি
- জীবনানন্দ দাশ---বনলতা সেন
আমাকে
তুমি দেখিয়েছিলে একদিন :
মস্ত বড় ময়দান — দেবদারু পামের নিবিড় মাথা — মাইলের পর মাইল;
দুপুরবেলার জনবিরল গভীর বাতাস
দূর শূন্যে চিলের পাটকিলে ডানার ভিতর অস্পষ্ট হয়ে হারিয়ে যায়;
জোয়ারের মতো ফিরে আসে আবার;
জানালায় জানালায় অনেক ক্ষণ ধরে কথা বলে:
পৃথিবীকে মায়াবী নদীর পারের দেশ বলে মনে হয়।
তারপর
দূরে
অনেক দূরে
খররৌদ্রে পা ছড়িয়ে বর্ষীয়সী রূপসীর মাতা ধান ভানে — গান
গায়- গান গায়-
এই দুপুরের বাতাস।
এক একটা দুপুরে এক একটা পরিপূর্ণ জীবন অতিবাহিত হয়ে যায় যেন।
বিকেলে নরম মুহুর্ত;
নদীর জলের ভিতর শম্বর, নীলগাই, হরিণের ছায়ার আসা- যাওয়া;
একটা ধবল চিতল-হরিণীর ছায়া
আতার ধূসর ক্ষীরে গড়া মুর্তির মতো
নদীর জলে
সমস্ত বিকেলবেলা ধরে
স্থির ।
মাঝে মাঝে অনেক দূর থেকে শ্মশানের চন্দনকাঠের চিতার গন্ধ,
আগুণের — ঘিয়ের ঘ্রাণ;
বিকেলে
অসম্ভব বিষন্নতা।
ঝাউ হরিতকী শাল, নিভন্ত সূর্যে
পিয়াশাল পিয়াল আমলকি দেবদারু–
বাতাসের বুকে স্পৃহা, উৎসাহ, জীবনের ফেনা;
শাদা শাদাছিট কালো পায়রার ওড়াওড়ি জ্যোৎস্নায়–ছায়ায়,
রাত্রি;
নক্ষত্র ও নক্ষত্রের
অতীত নিস্তব্ধতা!
মরণের পরপারে বড়ো অন্ধকার
এই সব আলো প্রেম ও নির্জনতার মতো ।
স্বপ্নের ধ্বনিরা
- জীবনানন্দ দাশ---বনলতা সেন
স্বপ্নের ধ্বনিরা এসে বলে যায়: স্থবিরতা সব চেয়ে ভালো;
নিস্তব্ধ শীতের রাতে দীপ জ্বেলে
অথবা নিভায়ে দীপ বিছানায় শুয়ে
স্থবিরের চোখে যেন জমে ওঠে অন্য কোন বিকেলের আলো।
সেই আলো চিরদিন হয়ে থাকে স্থির,
সব ছেড়ে একদিন আমিও স্থবির
হয়ে যাব; সেদিন শীতের রাতে সোনালী জরির কাজ ফেলে
প্রদীন নিভায়ে রবো বিছানায় শুয়ে:
অন্ধকারে ঠেস দিয়ে জেগে রবো
বাদুড়ের আঁকাবাঁকা আকাশের মতো।
স্থবিরতা, করে তুমি আসিবে বলো তো।
অবশেষে
- জীবনানন্দ দাশ---বনলতা সেন
এখানে প্রশান্ত মনে খেলা করে উঁচু উঁচু গাছ।
সবুজ পাতার পরে যখন নেমেছে এসে দুপুরের সূর্যের আঁচ
নদীতে স্মরণ করে একবার পৃথিবীর সকাল বেলাকে।
আবার বিকেল হলে অতিকায় হরিণের মতো শান্ত থাকে।
এই সব গাছুগুলো; -যেন কোন দূর থেকে অস্পষ্ট বাতাস
বাঘের ঘ্রাণের মতো হৃদয়ে জাগায়ে যায় ত্রাস;
চেয়ে দেখ ইহাদের পরস্পর নীলিম বিন্যাস
নড়ে উঠে ত্রস্ততায়;- আধো নীল আকাশের বুকে
হরিণের মতো দ্রুত ঠ্যাঙের তুরুকে
অন্তর্হিত হয়ে যেতে পারে তারা বটে ;
একজোটে কাজ করে মানুষেরা যে রকম ভোটের ব্যালটে;
তবুও বাঘিনী হয়ে বাতাসকে আলিঙ্গন করে–
সাগরের বালি আর রাত্রির নক্ষত্রের তরে।
দুজন
- জীবনানন্দ দাশ---বনলতা সেন
‘আমাকে খোঁজো না তুমি বহুদিন-কতদিন আমিও তোমাকে
খুঁজি নাকো;- এক নক্ষত্রের নিচে তবু-একই আলোপৃথিবীর পারে
আমরা দুজনে আছি; পৃথিবীর পুরনো পথের রেখা হয়ে যায় ক্ষয়,
প্রেম ধীরে মুছে যায়, নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়,
হয় নাকি?’- বলে সে তাকাল তার সঙ্গিনীর দিকে;
আজ এই মাঠ সূর্য সহধর্মী অঘ্রাণ কার্তিকে
প্রাণ তার ভরে গেছে।
দুজনে আজকে তারা চিরস্থায়ী পৃথিবীর ও আকাশের পাশে
আবার প্রথম এল-মনে হয়- যেন কিছু চেয়ে-কিছু একান্ত বিশ্বাসে।
লালচে হলদে পাতা অনুষঙ্গে জাম বট অশ্বত্থের শাখার ভিতরে
অন্ধকারে নড়ে- চড়ে ঘাসের উপর ঝরে পড়ে;
তারপর সান্ত্বনায় থাকে চিরকাল;
যেখানে আকাশে খুব নীরবতা,শান্তি খুব আছে,
হৃদয়ে প্রেমের গল্প শেষ হলে ক্রমে ক্রমে যেখানে মানুষ
আশ্বাস খুঁজেছে এসে সময়ের দায়ভাগী নক্ষত্রের কাছে:
সেই ব্যাপ্ত প্রান্তরে দুজন; চারিদিকে ঝাউ আম নিম নাগেশ্বরে
হেমন্ত আসিয়া গেছে;-চিলের সোনালি ডানা হয়েছে খয়েরি;
ঘুঘুর পালক যেন ঝরে গেছে- শালিকের নেই আর দেরি,
হলুদ কঠিন ঠ্যাং উঁচু করে ঘুমাবে সে শিশিরের জলে;
ঝরিছে মরিছে সব এই খানে বিদায় নিতেছে ব্যাপ্ত নিয়মের ফলে।
নারী তার সঙ্গীকে : ‘পৃথিবীর পুরনো পথের রেখা হয়ে যায় ক্ষয়,
জানি আমি; — তারপর আমাদের দুঃস্থ হৃদয়
কী নিয়ে থাকিবে বলো; — একদিন হৃদয়ে আঘাত ঢের দিয়েছে চেতনা,
তারপর ঝরে গেছে; আজ তবু মনে হয় যদি ঝরিত না
হৃদয়ে প্রেমের শীর্ষ আমাদের — প্রেমের অপূর্ব শিশু আরক্ত বাসনা
ফুরত না যদি, আহা, আমাদের হৃদয়ের থেকে–’
এই বলে ম্রিয়মাণ আঁচলের সর্বস্বতা দিয়ে মুখ ঢেকে
উদ্বেল কাশের বনে দাঁড়িয়ে রইল হাঁটুভর।
হলুদরঙের শাড়ি, চোরকাঁটা বিঁধে আছ, এলোমেলো অঘ্রাণের খড়
চারিদিকে শূন্য থেকে ভেসে এসে ছুঁয়ে ছেনে যেতেছে শরীর;
চুলের উপর তার কুয়াশা রেখেছে হাত, ঝরিছে শিশির;–
প্রেমিকের মনে হল : ‘এই নারী-অপরূপ-খুঁজে পাবে নক্ষত্রের তীরে
যেখানে রবো না আমি, রবে না মাধুরী এই, রবে না হতাশা,
কুয়াশা রবে না আর — জনিত বাসনা নিজে — বাসনার মতো ভালোবাসা
খুঁজে নেবে অমৃতের হরিণীর ভিড় থেকে ইপ্সিতেরে তার।’
শ্যামলী
- জীবনানন্দ দাশ---বনলতা সেন
শ্যামলী, তোমার মুখ সেকালের শক্তির মতন:
যখন জাহাজে চড়ে যুবকের দল
সুদূর নতুন দেশে সোনা আছে বলে,
মহিলারি প্রতিভায় সে ধাতু উজ্জ্বল
টের পেয়ে, দ্রাক্ষা দুধ ময়ূরশয্যার কথা ভুলে
সকালের রূঢ় রৌদ্র ডুবে যেত কোথায় অকূলে।
তোমার মুখের দিকে তাকালে এখনো
আমি সেই পৃথিবীর সমুদ্রে নীল,
দুপুরের শূন্য সব বন্দরের ব্যথা,
বিকেলের উপকন্ঠে সাগরের চিল,
নক্ষত্র, রাত্রির জল, যুবাদের ক্রন্দন সব–
শ্যামলী, করেছি অনুভব।
অনেক অপরিমেয় যুগ কেটে গেল;
মানুষকে স্থির- স্থিরতর হতে দেবে না সময়;
সে কিছু চেয়েছে বলে এত রক্ত নদী।
অন্ধকার প্রেরণার মতো মনে হয়
দূর সাগরের শব্দ — শতাব্দীর তীরে এসে ঝরে :
কমলালেবু
- জীবনানন্দ দাশ---বনলতা সেন
একবার যখন দেহ থেকে বার হয়ে যাব
আবার কি ফিরে আসব না আমি পৃথিবীতে?
আবার যেন ফিরে আসি
কোনো এক শীতের রাতে
একটা হিম কমলালেবুর করুণ মাংস নিয়ে
কোনো এক পরিচিত মুমূর্ষুর বিছানার কিনারে।
অন্ধকার
- জীবনানন্দ দাশ---বনলতা সেন
গভীর অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর চ্ছল চ্ছল শব্দে জেগে উঠলাম আবার;
তাকিয়ে দেখলাম পান্ডুর চাঁদ বৈতরণীর থেকে তার অর্ধেক ছায়া
গুটিয়ে নিয়েছে যেন
কীর্তিনাশার দিকে।
ধারসিড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়েছিলাম- পউষের রাতে-
কোনোদিন আর জাগব না জেনে
কোনোদিন জাগব না আমি- কোনোদিন জাগব না আর-
হে নীল কস্তুরী আভার চাঁদ,
তুমি দিনের আলো নও, উদ্যম নও, স্বপ্ন নও,
হৃদয়ে যে মৃত্যুর শান্তি ও স্থিরতা রয়েছে
রয়েছে যে অগাধ ঘুম
সে-আস্বাদ নষ্ট করবার মতো শেলতীব্রতা তোমার নেই,
তুমি প্রদাহ প্রবহমান যন্ত্রণা নও-
জানো না কি চাঁদ,
নীল কস্তুরী আভার চাঁদ,
জানো না কি নিশীথ,
আমি অনেক দিন-
অনেক অনেক দিন
অন্ধকারের সারাৎসারে অন্তত মৃত্যুর মতো মিশে থেকে
হঠাৎ ভোরের আলোর মূর্খ উচ্ছ্বাসে নিজেকে পৃথিবীর জীব বলে
বুঝতে পেরেছি আবার;
ভয় পেয়েছি,
পেয়েছি অসীম দুর্নিবার বেদনা;
দেখেছি রক্তিম আকাশে সূর্য জেগে উঠে
মানুষিক সৈনিক সেজে পৃথিবীর মুখোমুখি দাঁড়াবার জন্য
আমাকে নির্দেশ দিয়েছে;
আমার সমস্ত হৃদয় ঘৃণায়- বেদনায়- আক্রোশে ভরে গিয়েছে;
সূর্যের রৌদ্রে আক্রান্ত এই পৃথিবী যেন কোটি কোটি শুয়োরের
আর্তনাদে উৎসব শুরু করেছে ।
হায়, উৎসব!
হৃদয়ের অবিরল অন্ধকারের ভিতর সূর্যকে ডুবিয়ে ফেলে
আবার ঘুমোতে চেয়েছি আমি,
অন্ধকারের স্তনের যোনির ভিতর অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে
থাকতে চেয়েছি।
কোনোদিন মানুষ ছিলাম না আমি।
হে নর, হে নারী,
তোমাদের পৃথিবীকে চিনিনি কোনোদিন;
আমি অন্য কোনো নক্ষত্রের জীব নই।
যেখানে স্পন্দন, সংঘর্ষ, গতি, যেখানে উদ্যম, চিন্তা, কাজ
সেখানেই সূর্য, পৃথিবী, বৃহস্পতি, কালপুরুষ, অনন্ত আকাশগ্রন্থি,
শত শত শূকরের চিৎকার সেখানে,
শত শত শূকরের প্রসববেদনার আড়ম্বর;
এই সব ভয়াবহ আরতি!
গভীর অন্ধকারের ঘুমের আস্বাদে আমার আত্মা লালিত;
আমাকে কেন জাগাতে চাও?
হে সময়গ্রন্থি, হে সূর্য, হে মাঘনিশীথের কোকিল, হে স্মৃতি,
হে হিম হাওয়া,
আমাকে জাগাতে চাও কেন।
অরব অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর চ্ছল চ্ছল শব্দে জেগে উঠব না আর;
তাকিয়ে দেখব না নির্জন বিমিশ্র চাঁদ বৈতরণীর থেকে
অর্ধেক ছায়া গুটিয়ে নিয়েছে
কীর্তিনাশার দিকে।
ধানসিড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়ে থাকব-ধীরে-পউষের রাতে।
কোনদিন জাগব না জেনে-
কোনোদিন জাগব না আমি-কোনোদিন আর।
সুদর্শনা
- জীবনানন্দ দাশ---বনলতা সেন
একদিন ম্লান হেসে আমি
তোমার মতন এক মহিলার কাছে
যুগের সঞ্চিত পণ্যে লীন হতে গিয়ে
অগ্নিপরিধির মাঝে সহসা দাঁড়িয়ে
শুনেছি কিন্নরকন্ঠ দেবদারু গাছে,
দেখেছ অমৃতসূর্য আছে।
সবচেয়ে আকাশ নক্ষত্র ঘাস চন্দ্রমল্লিকার রাত্রি ভালো;
তবুও সময় স্থির নয়,
আরেক গভীরতর শেষ রূপ চেয়ে
দেখেছে সে তোমার বলয়।
এই পৃথিবীর ভালো পরিচিত রোদের মতন
তোমার শরীর; তুমি দান করোনি তো;
সময় তোমাকে সব দান করে মৃতদার বলে
বেড়াল
- জীবনানন্দ দাশ---বনলতা সেন
সারাদিন একটা বেড়ালের সঙ্গে ঘুরে ফিরে কেবলি আমার দেখা হয়:
গাছের ছায়ায়, রোদের ভিতরে, বাদামি পাতার ভিড়ে;
কোথাও কয়েক টুকরো মাছের কাঁটার সফলতার পর
তারপর সাদা মাটির কঙ্কালের ভিতর
নিজের হৃদয়কে নিয়ে মৌমাছির মতো নিমগ্ন হয়ে আছে দেখি;
কিন্তু তবুও তারপর কৃষ্ণচূড়ার গায়ে নখ আঁচড়াচ্ছে,
সারাদিন সূর্যের পিছনে পিছনে চলেছে সে।
একবার তাকে দেখা যায়,
একবার হারিয়ে যায় কোথায়।
হেমন্তের সন্ধ্যায় জাফরান-রঙের সূর্যের নরম শরীরে
শাদা থাবা বুলিয়ে বুলিয়ে খেলা করতে দেখলাম তাকে;
তারপর অন্ধকারকে ছোট ছোট বলের মতো থাবা দিয়ে লুফে আনল সে
সমন্ত পৃথিবীর ভিতর ছড়িয়ে দিল।
হরিণেরা
- জীবনানন্দ দাশ---বনলতা সেন
স্বপ্নের ভিতরে বুঝি–ফাল্গুনের জ্যোৎস্নার ভিতরে।
দেখিলাম পলাশের বনে খেলা করে
হরিণেরা; রূপালি চাঁদের হাত শিশিরে পাতায়;
বাতাস ঝরিছে ডানা — মুক্তা ঝ’রে যায়
পল্লবের ফাঁকে ফাঁকে-বনে বনে-হরিণের চোখে;
হরিণেরা খেলা করে হাওয়া আর মুক্তার আলোকে।
হীরের প্রদীপ জ্বেলে শেফালিকা বোস যেন হাসে
হিজল ডালের পিছে অগণন বনের আকাশে,–
বিলুপ্ত ধূসর কোন পৃথিবীর শেফালিকা, আহা,
ফাল্গুনের জ্যোৎস্নায় হরিণেরা জানে শুধু তাহা।
বাতাস ঝাড়িছে ডানা, হীরা ঝরে হরিণের চোখে–
হরিণেরা খেলা করে হাওয়া আর হীরার আলোকে।
শিকার
- জীবনানন্দ দাশ---বনলতা সেন
ভোর;
আকাশের রং ঘাসফড়িঙের দেহের মতো কোমল নীল:
চারিদিকে পেয়ারা ও নোনার গাছ টিয়ার পালকের মতো সবুজ।
একটি তারা এখনো আকাশে রয়েছে :
পাড়াগাঁর বাসরঘরে সবচেয়ে গোধূলি-মদির মেয়েটির মতো;
কিংবা মিশরের মানুষী তার বুকের থেকে যে মুক্তা
আমার নীল মদের গেলাসে রেখেছিল
হাজার হাজার বছর আগে এক রাতে তেমনি-
তেমনি একটি তারা আকাশে জ্বলছে এখনো।
হিমের রাতে শরীর ‘উম্’ রাখবার জন্য দেশোয়ালিরা
সারারাত মাঠে আগুন জ্বেলেছে-
মোরগফুলের মতো লাল আগুন
শুকনো অশ্বত্থ পাতা দুমড়ে এখনো আগুন জ্বলছে তাদের;
সূর্যের আলোয় তার রঙ কুঙ্কুমের মতো নেই আর;
হয়ে গেছে রোগা শালিকের হৃদয়ের বিবর্ণ ইচ্ছার মতো।
সকালের আলোয় টলমল শিশিরে চারিদিকের বন ও আকাশ
ময়ূরের সবুজ নীল ডানার মতো ঝিলমিল করছে।
ভোর;
সারারাত চিতাবাঘিনীর হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে
নক্ষত্রহীন, মেহগনির মতো অন্ধকারে সুন্দরীর বন থেকে
অর্জুনের বনে ঘুরে ঘুরে
সুন্দর বাদামি হরিণ এই ভোরের জন্য অপেক্ষা করছিল।
এসেছে সে ভোরের আলোয় নেমে;
কচি বাতাবিলেবুর মতো সবুজ সুগন্ধী ঘাস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে;
নদীর তীক্ষ্ম শীতল ঢেউয়ে সে নামল-
ঘুমহীন ক্লান্ত বিহ্বল শরীরটাকে স্রোতের মতো একটা আবেগ দেওয়ার জন্য
অন্ধকারের হিম কুঞ্চিত জরায়ু ছিঁড়ে ভোরের রৌদ্রের মতো
একটা বিস্তীর্ণ উল্লাস পাবার জন্য,
এই নীল আকাশের নিচে সূর্যের সোনার বর্শার মতো জেগে উঠে
সাহসে সাথে সৌন্দর্যে হরিণীর পর হারিণীকে চমক লাগিয়ে দেবার জন্য।
একটা অদ্ভূত শব্দ।
নদীর জল মচকাফুলের মতো লাল।
আগুন জ্বলল আবার – উষ্ণ লাল হরিণের মাংস তৈরি হয়ে এল।
নক্ষত্রের নিচে ঘাসের বিছানায় বসে অনেক পুরনো শিশিরভেজা গল্প;
সিগারেটের ধোঁয়া;
টেরিকাটা কয়েকটা মানুষের মাথা;
এলোমেলো কয়েকটা বন্দুক – হিম – নিস্পন্দ নিরপরাধ ঘুম।
নগ্ন নির্জন হাত
- জীবনানন্দ দাশ---বনলতা সেন
আবার আকাশে অন্ধকার ঘন হয়ে উঠেছে:
আলোর রহস্যময়ী সহোদরার মতো এই অন্ধকার।
যে আমাকে চিরদিন ভালোবেসেছে
অথচ যার মুখ আমি কোনাদিন দেখিনি,
সেই নারীর মতো
ফাল্গুন আকাশে অন্ধকার নিবিড় হয়ে উঠেছে।
মনে হয় কোনো বিলুপ্ত নগরীর কথা
সেই নগরীর এক ধুসর প্রাসাদের রূপ জাগে হৃদয়ে।
ভারতসমুদ্রের তীরে
কিংবা ভূমধ্যসাগরের কিনারে
অথবা টায়ার সিন্ধুর পারে
আজ নেই, কোনা এক নগরী ছিল একদিন,
কোন এক প্রাসাদ ছিল;
মূল্যবান আসবাবে ভরা এক প্রাসাদ;
পারস্য গালিচা, কাশ্মিরী শাল, বেরিন তরঙ্গের নিটোল মুক্তা প্রবাল,
আমার বিলুপ্ত হৃদয়, আমার মৃত চোখ, আমার বিলীন স্বপ্ন আকাঙ্খা,
আর তুমি নারী-
এই সব ছিল সেই জগতে একদিন।
অনেক কমলা রঙের রোদ ছিল,
অনেক কাকাতুয়া পায়রা ছিল,
মেহগনির ছায়াঘর পল্লব ছিল অনেক;
অনেক কমলা রঙের রোদ ছিল;
অনেক কমলা রঙের রোদ;
আর তুমি ছিলে;
তোমার মুখের রূপ কত শত শতাব্দী আমি দেখি না,
খুঁজি না।
ফাল্গুনের অন্ধকার নিয়ে আসে সেই সমুদ্রপারের কাহিনী,
অপরূপ খিলানও গম্বুজের বেদনাময় রেখা,
লুপ্ত নাশপারিত গন্ধ,
অজস্র হরিণ ও সিংহের ছালের ধুসর পান্ডুলিপি,
রামধনু রঙের কাচের জানালা,
ময়ুরের পেখমের মতো রঙিন পর্দায় পর্দায়
কক্ষ ও কক্ষান্তর থেকে আরো দূর কক্ষ ও কক্ষান্তরের
ক্ষণিক আভাস-
আয়ুহীন স্তব্ধতা ও বিস্ময়।
পর্দায়, গালিচায় রক্তাভ রৌদ্রের বিচ্ছুরিত স্বেদ,
রক্তিম গেলাসে তরমুজ মদ!
তোমর নগ্ন নির্জন হাত;
তোমার নগ্ন নির্জন হাত।
শঙ্খমালা
- জীবনানন্দ দাশ---বনলতা সেন
কান্তারের পথ ছেড়ে সন্ধ্যার আঁধারে
সে কে এক নারী এসে ডাকিল আমারে,
বলিল, তোমারে চাই:
বেতের ফলের মতো নীলাভ ব্যথিত তোমার দুই চোখ
খুঁজেছি নক্ষত্রে আমি- কুয়াশার পাখনায়-
সন্ধ্যার নদীর জলে নামে যে আলোক
জোনাকির দেহ হতে-খুজেছি তোমারে সেইখানে-
ধূসর পেচার মতো ডানা মেলে অঘ্রাণের অন্ধকারে
ধানসিড়ি বেয়ে-বেয়ে
সোনার সিঁড়ির মতো ধানে আর ধানে
তোমারে খুঁজছি আমি নির্জন পেঁচার মতো প্রাণে।
দেখিলাম দেহ তার বিমর্ষ পাখির রঙে ভরা;
সন্ধ্যার আঁধারে ভিজে শিরীষের ডালে যেই পাখি দেয় ধরা-
বাঁকা চাঁদ থাকে যার মাথার উপর,
শিঙের মতন বাঁকা নীল চাঁদ শোনে যার স্বর।
কড়ির মতন সাদা মুখ তার;
দুইখানা হাত তার হিম;
চোখে তার হিজল কাঠের রক্তিম
চিতা জ্বলে: দক্ষিণ শিয়রে মাথা শঙ্খমালা যেন পুড়ে যায়
সে আগুনে হায়।
চোখে তার
যেন শত শতাব্দীর নীল অন্ধকার!
স্তন তার
করুণ শঙ্খের মতো – দুধে আর্দ্র-কবেকার শঙ্খিনীমালার!
এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর।
শঙ্খমালা
- জীবনানন্দ দাশ---বনলতা সেন
কান্তারের পথ ছেড়ে সন্ধ্যার আঁধারে
সে কে এক নারী এসে ডাকিল আমারে,
বলিল, তোমারে চাই:
বেতের ফলের মতো নীলাভ ব্যথিত তোমার দুই চোখ
খুঁজেছি নক্ষত্রে আমি- কুয়াশার পাখনায়-
সন্ধ্যার নদীর জলে নামে যে আলোক
জোনাকির দেহ হতে-খুজেছি তোমারে সেইখানে-
ধূসর পেচার মতো ডানা মেলে অঘ্রাণের অন্ধকারে
ধানসিড়ি বেয়ে-বেয়ে
সোনার সিঁড়ির মতো ধানে আর ধানে
তোমারে খুঁজছি আমি নির্জন পেঁচার মতো প্রাণে।
দেখিলাম দেহ তার বিমর্ষ পাখির রঙে ভরা;
সন্ধ্যার আঁধারে ভিজে শিরীষের ডালে যেই পাখি দেয় ধরা-
বাঁকা চাঁদ থাকে যার মাথার উপর,
শিঙের মতন বাঁকা নীল চাঁদ শোনে যার স্বর।
কড়ির মতন সাদা মুখ তার;
দুইখানা হাত তার হিম;
চোখে তার হিজল কাঠের রক্তিম
চিতা জ্বলে: দক্ষিণ শিয়রে মাথা শঙ্খমালা যেন পুড়ে যায়
সে আগুনে হায়।
চোখে তার
যেন শত শতাব্দীর নীল অন্ধকার!
স্তন তার
করুণ শঙ্খের মতো – দুধে আর্দ্র-কবেকার শঙ্খিনীমালার!
এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর।
বুনো হাঁস
- জীবনানন্দ দাশ---বনলতা সেন
পেঁচার ধূসর পাখা উড়ে যায় নক্ষত্রের পানে-
জলা মাঠ ছেড়ে দিয়ে চাঁদের আহবানে
বুনো হাঁস পাখা মেলে- শাঁই শাঁই শব্দ শুনি তার;
এক-দুই-তিন- চার-অজস্র-অপার-
রাত্রির কিনার দিয়ে তাহাদের ক্ষিপ্র ডানা ঝাড়া
এঞ্জিনের মতো শব্দে; ছুটিতেছে-ছুটিতেছে তারা।
তারপর পড়ে থাকে, নক্ষত্রের বিশাল আকাশ,
হাঁসের গায়ের ঘ্রাণ-দু-একটা কল্পনার হাঁস;
মনে পড়ে কবেকার পাড়াগাঁর অরুণিমা স্যানালের মুখ;
উড়ুক উড়ুক তারা পউষের জ্যোৎস্নায় নীরবে উড়ুক
কল্পনার হাঁস সব — পৃথিবীর সব ধ্বনি সব রঙ মুছে গেল পর
উড়ুক উড়ুক তারা হৃদয়ের শব্দহীন জ্যোৎস্নার ভিতর ।
বুনো হাঁস
- জীবনানন্দ দাশ---বনলতা সেন
পেঁচার ধূসর পাখা উড়ে যায় নক্ষত্রের পানে-
জলা মাঠ ছেড়ে দিয়ে চাঁদের আহবানে
বুনো হাঁস পাখা মেলে- শাঁই শাঁই শব্দ শুনি তার;
এক-দুই-তিন- চার-অজস্র-অপার-
রাত্রির কিনার দিয়ে তাহাদের ক্ষিপ্র ডানা ঝাড়া
এঞ্জিনের মতো শব্দে; ছুটিতেছে-ছুটিতেছে তারা।
তারপর পড়ে থাকে, নক্ষত্রের বিশাল আকাশ,
হাঁসের গায়ের ঘ্রাণ-দু-একটা কল্পনার হাঁস;
মনে পড়ে কবেকার পাড়াগাঁর অরুণিমা স্যানালের মুখ;
উড়ুক উড়ুক তারা পউষের জ্যোৎস্নায় নীরবে উড়ুক
কল্পনার হাঁস সব — পৃথিবীর সব ধ্বনি সব রঙ মুছে গেল পর
উড়ুক উড়ুক তারা হৃদয়ের শব্দহীন জ্যোৎস্নার ভিতর ।
ঘাস
- জীবনানন্দ দাশ---বনলতা সেন
কচি লেবুপাতার মতো নরম সবুজ আলোয়
পৃথিবী ভরে গিয়েছে এই ভোরের বেলা;
কাঁচা বাতাবির মতো সবুজ ঘাস- তেমনি সুঘ্রাণ –
হরিনেরা দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে নিচ্ছে !
আমারো ইচ্ছা করে এই ঘাসের এই ঘ্রাণ হরিৎ মদের মতো
গেলাসে গেলাসে পান করি,
এই ঘাসের শরীর ছানি- চোখে ঘসি,
ঘাসের পাখনায় আমার পালক,
ঘাসের ভিতর ঘাস হয়ে জন্মাই কোনো এক নিবিড় ঘাস-মাতার
শরীরের সুস্বাদু অন্ধকার থেকে নেমে ।
আমি যদি হতাম
- জীবনানন্দ দাশ---বনলতা সেন
আমি যদি হতাম বনহংস,
বনহংসী হতে যদি তুমি;
কোনো এক দিগন্তের জলসিঁড়ি নদীর ধারে
ধানক্ষেতের কাছে
ছিপছিপে শরের ভিতর
এক নিরালা নীড়ে;
তাহলে আজ এই ফাল্পুনের রাতে
ঝাউয়ের শাখার পেছনে চাঁদ উঠতে দেখে
আমরা নিম্নভূমির জলের গন্ধ ছেড়ে
আকাশের রুপালি শস্যের ভিতর গা ভাসিয়ে দিতাম-
তোমার পাখনায় আমার পালক, আমার পাখনায় তোমার রক্তের স্পন্দন-
নীল আকাশে খইক্ষেতের সোনালি ফুলের মতো অজস্র তারা,
শিরীষ বনের সবুজ রোমশ নীড়ে
সোনার ডিমের মতো
ফাল্গুনের চাঁদ।
হয়তো গুলির শব্দঃ
আমাদের তির্যক গতিস্রোত,
আমাদের পাখায় পিস্টনের উল্লাস,
আমাদের কন্ঠে উত্তর হাওয়ার গান!
হয়তো গুলির শব্দ আবারঃ
আমাদের স্তব্ধতা,
আমাদের শান্তি।
আজকের জীবনের এই টুকরো টুকরো মৃত্যু আর থাকত না:
থাকত না আজকের জীবনের টুকরো টুকরো সাধের ব্যর্থতা ও অন্ধকার;
আমি যদি বনহংস হতাম,
বনহংসী হতে যদি তুমি;
কোনো এক দিগন্তের জলসিড়ি নদীর ধারে
ধানক্ষেতের কাছে ।
হাওয়ার রাত
- জীবনানন্দ দাশ---বনলতা সেন
গভীর হাওয়ার রাত ছিল কাল-অসংখ্য নক্ষত্রের রাত ;
সারা রাত বির্স্তীর্ণ হাওয়া আমার মশারিতে খেলেছে;
মশারিটা ফুলে উঠেছে কখনো মৌসুমী সমুদ্রের পেটের মতো,
কখনো বিছানা ছিঁড়ে
নক্ষত্রের দিকে উড়ে যেতে চেয়েছে,
এক-একবার মনে হচ্ছিল আমার-আধো ঘুমের ভিতর হয়তো-
মাথার উপরে মশারি নেই আমার
স্বাতী তারার কোল ঘেঁষে নীল হাওয়ার সমুদ্রে শাদা বকের মতো
উড়ছে সে!
কাল এমন চমৎকার রাত ছিল।
সমস্ত মৃত নক্ষত্রেরা কাল জেগে উঠেছিল-আকাশে একতিন ফাঁক ছিল না;
পৃথিবীর সমস্ত ধূরস প্রিয় মৃতদের মুখও সেই নক্ষত্রের
ভিতর দেখেছি আমি;
অন্ধকার রাতে অশ্বত্থের চূড়ায় প্রেমিক চিলপুরুষের শিশির-ভেজা চোখের
মতো ঝলমল করছিল সমস্ত নক্ষত্রেরা;
জ্যোৎস্নারাতে বেবিলনের রাণীর ঘাড়ের ওপর চিতার উজ্জ্বল চামড়ার
শালের মতো জ্বলজ্বল করছিল বিশাল আকাশ!
কাল এমন আশ্চর্য রাত ছিল।
যে নক্ষত্রেরা আকাশের বুকে হাজার হাজার বছর আগে মরে গিয়েছে
তারাও কাল জানালার ভিতর দিয়ে অসংখ্য মৃত আকাশ সঙ্গে করে এনেছে;
যে রূপসীদের আমি এশিরিয়ার, মিশরে বিদিশায় মরে যেতে দেখেছি
কাল তারা অতিদূরে আকাশের সীমানার কুয়াশায় কুয়াশায় দীর্ঘ বর্শা হাতে
করে কাতারে কাতের দাঁড়িয়ে গেছে যেন-
মৃত্যুকে দলিত করবার জন্য?
জীবনের গভীর জয় প্রকাশ করবার জন্য?
প্রেমের ভয়াবহ গম্ভীর স্তম্ভ তুলবার জন্য?
আড়ষ্ট-অভিভূত হয়ে গেছি আমি,
কাল রাতের প্রবল নীল অত্যাচার আমাকে ছিঁড়ে ফেলেছে যেন;
আকাশের বিরামহীন বিস্তীর্ণ ডানার ভিতর
পৃথিবী কীটের মতো মুছে গিয়েছে কাল!
আর উত্তুঙ্গ বাতাস এসেছে আকাশের বুক থেকে নেমে
আমার জানালার ভিতর দিয়ে, শাঁই শাঁই করে,
সিংহের হুঙ্কারে উৎক্ষিপ্ত হরিৎ প্রান্তরের অজস্র জেব্রার মতো!
হৃদয় ভরে গিয়েছে আমার বিস্তীর্ণ ফেল্টের সবুজ ঘাসের গন্ধে,
দিগন্ত-প্লাবিত বলীয়ান রৌদ্রের আঘ্রাণে
মিলনোন্মত্ত বাঘিনীর গর্জনের মতো অন্ধকারের চঞ্চল বিরাট সজীব
রোমশ উচ্ছ্বাসে,
জীবনের দুর্দান্ত নীল মত্ততায়!
আমার হৃদয় পৃথিবী ছিঁড়ে উড়ে গেল,
নীল হাওয়ার সমুদ্রে স্ফীত মাতাল বেলুনের মতো গেল উড়ে,
একটা দূর নক্ষত্রের মাস্তুলকে তারায়-তারায় উড়িয়ে নিয়ে চলল
একটা দুরন্ত শকুনের মতো।
কুড়ি বছর পরে
- জীবনানন্দ দাশ---বনলতা সেন
আবার বছর কুড়ি পরে তার সাথে দেখা হয় যদি!
আবার বছর কুড়ি পরে-
হয়তো ধানের ছড়ার পাশে
কার্তিকের মাসে-
তখন সন্ধ্যার কাক ঘরে ফেরে-তখন হলুদ নদী
নরম নরম হয় শর কাশ হোগলায়-মাঠের ভিতরে!
অথবা নাইকো ধান ক্ষেতে আর,
ব্যস্ততা নাইকো আর,
হাঁসের নীড়ের থেকে খড়
পাখির নীড়ের থেকে খড়
ছড়াতেছে; মনিয়ার ঘরে রাত, শীত আর শিশিরের জল!
জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার-
তখন হঠাৎ যদি মেঠো পথে পাই আমি তোমারে আবার!
হয়তো এসেছে চাঁদ মাঝরাতে একরাশ পাতার পিছনে
সরু সরু কালো কালো ডালপালা মুখে নিয়ে তার,
শিরীষের অথবা জামের,
ঝাউয়ের-আমের;
কুড়ি বছরের পরে তখন তোমারে নাই মনে!
জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার-
তখন আবার যদি দেখা হয় তোমার আমার!
তখন হয়তো মাঠে হামাগুড়ি দিয়ে পেঁচা নামে
বাবলার গলির অন্ধকারে
অশথের জানালার ফাঁকে
কোথায় লুকায় আপনাকে!
চোখের পাতার মতো নেমে চুপি চিলের ডানা থামে-
সোনালি সোনালি চিল-শিশির শিকার করে নিয়ে গেছে তারে-
কুড়ি বছরের পরে সেই কুয়াশায় পাই যদি হঠাৎ তোমারে !
বনলতা সেন
- জীবনানন্দ দাশ---বনলতা সেন
হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন।
চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের ’পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে , ‘এতোদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।
সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে — সব নদী- ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।
সারাটি রাত্রি তারাটির সাথে তারাটিরই কথা হয়
- জীবনানন্দ দাশ---ঝরা পালক
চোখ দুটো ঘুমে ভরে
ঝরা ফসলের গান বুকে নিয়ে আজ ফিরে যাই ঘরে!
ফুরায়ে গিয়েছে যা ছিল গোপন,- স্বপন ক’দিন রয়!
এসেছে গোধূলি গোলাপিবরণ,-এ তবু গোধূলি নয়!
সারাটি রাত্রি তারাটির সাথে তারাটিরই কথা হয়,
আমাদের মুখ সারাটি রাত্রি মাটির বুকের’পরে!
কেটেছে যে নিশি ঢের,-
এতদিন তবু অন্ধকারের পাইনি তো কোনো টের!
দিনের বেলায় যাদের দেখিনি-এসেছে তাহারা সাঁঝে;
যাদের পাইনি পথের ধূলায়-ধোঁয়ায়-ভিড়ের মাঝে,-
শুনেছি স্বপনে তাদের কলসী ছলকে,- কাঁকন বাজে!
আকাশের নীচে- তারার আলোয় পেয়েছি যে তাহাদের!
চোখ দুটো ছিল জেগে
কত দিন যেন সন্ধ্যা-ভোরের নট্কান -রাঙা মেঘে!
কত দিন আমি ফিরেছি একেলা মেঘলা গাঁয়ের ক্ষেতে!
ছায়াধূপে চুপে ফিরিয়াছি প্রজাপতিটির মতো মেতে
কত দিন হায়!- কবে অবেলায় এলোমেলো পথে যেতে
ঘোর ভেঙে গেল,- খেয়ালের খেলাঘরটি গেল যে ভেঙে।
দুটো চোখ ঘুম ভরে
ঝরা ফসলের গান বুকে নিয়ে আজ ফিরে যাই ঘরে!
ফুরায়ে গিয়েছে যা ছিল গোপন,-স্বপন কদিন রয়!
এসেছে গোধূলি গোলাপিবরণ,-এ তবু গোধুলি নয়!
সারাটি রাত্রি তারাটির সাথে তারাটিরই কথা হয়,-
আমাদের মুখ সারাটি রাত্রি মাটির বুকের’ পরে !
ওগো দরদিয়া
- জীবনানন্দ দাশ---ঝরা পালক
-ওগো দরদিয়া,
তোমারে ভুলিবে সবে,- যাবে সবে তোমারে ত্যজিয়া;
ধরণীর পসরায় তোমারে পাবে না কেহ দিনান্তেও খুঁজে,
কে জানে রহিবে কোথা নিশিভোরে নেশাখোর আঁখি তব বুজে!
-হয়তো সিন্ধুর পারে শ্বেতশঙ্খ ঝিনুকের পাশে
তোমার কঙ্কালখানা শুয়ে রবে নিদ্রাহারা উর্মির নিশ্বাসে!
চেয়ে রবে নিষ্পলক অতি দূরে লহরীর পানে,
গীতিহারা প্রাণ তব হয়তো বা তৃপ্তি পাবে তরঙ্গের গানে!
হয়তো বা বনচ্ছায়া লতাগুল্ম পল্লবের তলে
ঘুমায়ে রহিবে তুমি নীলশষ্পে শিশিরের দলে;
হয়তো বা প্রান্তরের পারে তুমি র’বে শুয়ে প্রতিধ্বনিহারা,-
তোমারে হেরিবে শুধু হিমানীর শীর্ণাকাশ,-নীহারিকা,-তারা,
তোমারে চিনিবে শুধু প্রেত- জ্যোৎস্না,-বধির জোনাকি!
তোমারে চিনিবে শুধু আঁধারের আলেয়ার আঁখি!
তোমারে চিনিবে শুধু আকাশের কালো মেঘ-মৌন,-আলোহারা,
তোমারে চিনিয়া নেবে তমিস্রার তরঙ্গের ধারা!
কিংবা কেহ চিনিবে না,- হয়তো বা জানিবে না কেহ
কোথায় লুটায়ে আছে হেমন্তের দিবাশেষে ঘুমন্তের দেহ!
-হয়েছিল পরিচয় ধরণীর পান্তশালে যাহাদের সনে,
তোমার বিষাদহর্ষ গেঁথেছিলে একদিন যাহাদের মনে,
যাহাদের বাতায়নে একদিন গিয়েছিলে পথিক-অতিথি,
তোমারে ভুলিবে তারা,- ভুলে যাবে সব কথা,- সবটুকু স্মৃতি!
নাম তব মুছে যাবে মুসাফের,-অঙ্গারের পান্ডুলিপিখানি
নোনাধরা দেয়ালের বুক থেকে খ’সে যাবে কখন না জানি!
তোমার পানের পাত্রে নিঃশেষে শুকায়ে যাবে শেষের তলানি,
দন্ড দুই মাছিগুলো করে যাবে মিছে কানাকানি!
তারপর উড়ে যাবে দূরে দূরে জীবনের সুরার তল্লাসে,
মৃত এক অলি শুধু পড়ে রবে মাতালের বিছানার পাশে!
পেয়ালা উপুড় করে হয়তো বা রেখে যাবে কোনো একজন,
কোথা গেছে ইয়োসোফ্ জানে না সে,- জানে না সে গিয়েছে কখন।
জানে না যে,- অজানা সে,- আরবার দাবি নিয়ে আসিবে না ফিরে,-
জানে না যে চাপা পড়ে গেছে সে যে কবেকার কোথাকার ভিড়ে!
-জানিতে চাহে না কিছু,-ঘাড় নিচু ক’রে কে বা রাখে আঁখি বুজে
অতীত স্মৃতির ধ্যানে, অন্ধকার গৃহকোণে একখানা শূন্য পাত্র খুঁজে!
-যৌবনের কোন্ এক নিশীথে সে কবে
তুমি যে আসিয়াছিলে বনরাণী। জীবনের বাসন্তী-উৎসবে
তুমি যে ঢালিয়াছিলে ফাগরাগ,-আপনার হাতে মোর সুরাপাত্রখানি
তুমি যে ভরিয়াছিলে,-জুড়ায়েছে আজ তার ঝাঁঝ,- গেছে ফুরায়ে তলানি।
তবু তুমি আসিলে না,- বারেকের তরে দেখা দিলে নাকো হায়!
চুপে চুপে কবে আমি বসুধার বুক থেকে নিয়েছি বিদায়-
তুমি তাহা জানিলে না,-চলে গেছে মুসাফের,
কবে ফের দেখা হবে আহা
কে বা জানে! কবরের’ পরে তার পাতা ঝরে,-হাওয়া কাঁদে হা হা!
সেদিন এ ধরণীর
- জীবনানন্দ দাশ---ঝরা পালক
সেদিন এ ধরণীর
সবুজ দ্বীপের ছায়া-উতরোল তরঙ্গের ভিড়
মোর চোখে জেগে জেগে ধীরে ধীরে হোল অপহত,-
কুয়াশায় ঝ’রে- পড়া আতসের মতো!
দিকে দিকে ডুবে গেল কোলাহল,-
সহসা উজানজলে ভাঁটা গেল ভাসি!
অতিদূর আকাশের মুখখানা আসি
বুকে মোর তুলে গেল যেন হাহাকার
সেই দিন মোর অভিসার
মৃত্তিকার শূন্য- পেয়ালার ব্যথা একাকারে ভেঙে
বকের পাখার মতো শাদা লঘু মেঘে
ভেসেছিল আতুর,- উদাসী!
বনের ছায়ার নিচে ভাসে কার ভিজে চোখ
কাঁদে কার বারোঁয়ার বাঁশি
সেদিন শুনিনি তাহা,-
ক্ষুধাতুর দুটি আঁখি তুলে
অতিদূর তারকার কামনায় তরী মোর দিয়েছিনু খুলে!
আমার এ শিরা-উপশিরা
চকিতে ছিঁড়িয়া গেল ধরণীর নাড়ীর বন্ধন,-
শুনেছিনু কান পেতে জননীর স্থবির ক্রন্দন,
মোর তরে পিছুডাক মাটি-মা,- তোমার!
ডেকেছিল ভিজে ঘাস,-হেমন্তের হিম মাস, জোনাকির ঝাড়!
আমারে ডাকিয়াছিল আলেয়ার লাল মাঠ-শ্মশানের খেয়াঘাট আসি!
কঙ্কালের রাশি,
দাউদাউ চিতা,-
কত পূর্বজাতকের পিতামহ-পিতা,
সর্বনাশ ব্যসন-বাসনা,
কত মৃত গোক্ষুরার ফণা,
কত তিথি,- কত যে অতিথি,
কত শত যোনিচক্রস্মৃতি
করেছিল উতলা আমারে!
আধো আলো-আধেক আঁধারে
মোর সাথে মোর পিছে এল তারা ছুটে!
মাটির বাঁটের চুমা শিহরি উঠিল মোর ঠোঁটে,-রোমপুটে!
ধূ ধূ মাঠ,-ধানক্ষেত,-কাশফুল,-বুনোহাঁস,-বালুকার চর
বকের ছানার মতো যেন মোর বুকের উপর
এলোমেলো ডানা মেলে মোর সাথে চলিল নাচিয়া!
-মাঝপথে থেমে গেল তারা সব,
শকুনের মতো শূন্যে পাখা বিথারিয়া
দূরে,- দূরে,- আরো দূরে,-আরো দূরে চলিলাম উড়ে,
নিঃসহায় মানুষের শিশু একা,- অনন্তের শুক্ল অন্তঃপুরে
অসীমের আঁচলের তলে!
স্ফীত সমুদ্রের মতো আনন্দের আর্ত কোলাহলে
উঠিলাম উথলিয়া দুরন্ত সৈকতে,
দূর ছায়াপথে!
পৃথিবীর প্রেত চোখ বুঝি
সহসা উঠিল ভাসি তারকা-দর্পণে মোর অপহৃত আননের প্রতিবিম্ব খুঁজি!
ভ্রূণ-ভ্রষ্ট সন্তানের তরে
মাটি-মা ছুটিয়া এল বুকফাটা মিনতির ভরে,-
সঙ্গে নিয়ে বোবা শিশু-বৃদ্ধ মৃত পিতা
সূতিকা-আলয় আর শ্মশানের চিতা।
মোর পাশে দাঁড়াল সে গর্ভিণীর ক্ষোভে,
মোর দুটি শিশু আঁখি-তারকার লোভে
কাঁদিয়া উঠিল তার পীনস্তন,- জননীর প্রাণ।
জরায়ুর ডিম্বে তার জন্মিয়াছে যে ঈপ্সিত- বাঞ্ছিত সন্তান
তার তরে কালে কালে পেতেছে সে শৈবালবিছানা,- শালতমালের ছায়া।
এনেছে সে নব নব ঋতুরাগ,-পউষনিশির মেঘে ফাগুনের ফাগুয়ার মায়া!
তার তারে বৈতরণীতীরে সে যে ঢালিয়াছে গঙ্গার গাগরী,
মৃত্যুর অঙ্গার মথি স্তন তার বারবার ভিজা রসে
উঠিয়াছে ভরি।
উঠিয়াছে দূর্বাধানে শোভি,
মানবের তরে সে যে এনেছে মানবী!
মশলা-দরাজ এই মাটিটার ঝাঁঝ যে রে,-
কেন তবে দুদণ্ডের অশ্রু-অমানিশা
দূর আকাশের তরে বুকে তোর তুলে যায় নেশাখোর মক্ষিকার তৃষা!
নয়ন মুদিনু ধীরে,- শেষ আলো নিভে গেল পলাতকা নীলিমার পারে,
সদ্য প্রসূতির মতো অন্ধকার বসুন্ধরা আবরি আমারে।
সেদিন এ ধরণীর
- জীবনানন্দ দাশ---ঝরা পালক
সেদিন এ ধরণীর
সবুজ দ্বীপের ছায়া-উতরোল তরঙ্গের ভিড়
মোর চোখে জেগে জেগে ধীরে ধীরে হোল অপহত,-
কুয়াশায় ঝ’রে- পড়া আতসের মতো!
দিকে দিকে ডুবে গেল কোলাহল,-
সহসা উজানজলে ভাঁটা গেল ভাসি!
অতিদূর আকাশের মুখখানা আসি
বুকে মোর তুলে গেল যেন হাহাকার
সেই দিন মোর অভিসার
মৃত্তিকার শূন্য- পেয়ালার ব্যথা একাকারে ভেঙে
বকের পাখার মতো শাদা লঘু মেঘে
ভেসেছিল আতুর,- উদাসী!
বনের ছায়ার নিচে ভাসে কার ভিজে চোখ
কাঁদে কার বারোঁয়ার বাঁশি
সেদিন শুনিনি তাহা,-
ক্ষুধাতুর দুটি আঁখি তুলে
অতিদূর তারকার কামনায় তরী মোর দিয়েছিনু খুলে!
আমার এ শিরা-উপশিরা
চকিতে ছিঁড়িয়া গেল ধরণীর নাড়ীর বন্ধন,-
শুনেছিনু কান পেতে জননীর স্থবির ক্রন্দন,
মোর তরে পিছুডাক মাটি-মা,- তোমার!
ডেকেছিল ভিজে ঘাস,-হেমন্তের হিম মাস, জোনাকির ঝাড়!
আমারে ডাকিয়াছিল আলেয়ার লাল মাঠ-শ্মশানের খেয়াঘাট আসি!
কঙ্কালের রাশি,
দাউদাউ চিতা,-
কত পূর্বজাতকের পিতামহ-পিতা,
সর্বনাশ ব্যসন-বাসনা,
কত মৃত গোক্ষুরার ফণা,
কত তিথি,- কত যে অতিথি,
কত শত যোনিচক্রস্মৃতি
করেছিল উতলা আমারে!
আধো আলো-আধেক আঁধারে
মোর সাথে মোর পিছে এল তারা ছুটে!
মাটির বাঁটের চুমা শিহরি উঠিল মোর ঠোঁটে,-রোমপুটে!
ধূ ধূ মাঠ,-ধানক্ষেত,-কাশফুল,-বুনোহাঁস,-বালুকার চর
বকের ছানার মতো যেন মোর বুকের উপর
এলোমেলো ডানা মেলে মোর সাথে চলিল নাচিয়া!
-মাঝপথে থেমে গেল তারা সব,
শকুনের মতো শূন্যে পাখা বিথারিয়া
দূরে,- দূরে,- আরো দূরে,-আরো দূরে চলিলাম উড়ে,
নিঃসহায় মানুষের শিশু একা,- অনন্তের শুক্ল অন্তঃপুরে
অসীমের আঁচলের তলে!
স্ফীত সমুদ্রের মতো আনন্দের আর্ত কোলাহলে
উঠিলাম উথলিয়া দুরন্ত সৈকতে,
দূর ছায়াপথে!
পৃথিবীর প্রেত চোখ বুঝি
সহসা উঠিল ভাসি তারকা-দর্পণে মোর অপহৃত আননের প্রতিবিম্ব খুঁজি!
ভ্রূণ-ভ্রষ্ট সন্তানের তরে
মাটি-মা ছুটিয়া এল বুকফাটা মিনতির ভরে,-
সঙ্গে নিয়ে বোবা শিশু-বৃদ্ধ মৃত পিতা
সূতিকা-আলয় আর শ্মশানের চিতা।
মোর পাশে দাঁড়াল সে গর্ভিণীর ক্ষোভে,
মোর দুটি শিশু আঁখি-তারকার লোভে
কাঁদিয়া উঠিল তার পীনস্তন,- জননীর প্রাণ।
জরায়ুর ডিম্বে তার জন্মিয়াছে যে ঈপ্সিত- বাঞ্ছিত সন্তান
তার তরে কালে কালে পেতেছে সে শৈবালবিছানা,- শালতমালের ছায়া।
এনেছে সে নব নব ঋতুরাগ,-পউষনিশির মেঘে ফাগুনের ফাগুয়ার মায়া!
তার তারে বৈতরণীতীরে সে যে ঢালিয়াছে গঙ্গার গাগরী,
মৃত্যুর অঙ্গার মথি স্তন তার বারবার ভিজা রসে
উঠিয়াছে ভরি।
উঠিয়াছে দূর্বাধানে শোভি,
মানবের তরে সে যে এনেছে মানবী!
মশলা-দরাজ এই মাটিটার ঝাঁঝ যে রে,-
কেন তবে দুদণ্ডের অশ্রু-অমানিশা
দূর আকাশের তরে বুকে তোর তুলে যায় নেশাখোর মক্ষিকার তৃষা!
নয়ন মুদিনু ধীরে,- শেষ আলো নিভে গেল পলাতকা নীলিমার পারে,
সদ্য প্রসূতির মতো অন্ধকার বসুন্ধরা আবরি আমারে।
স্মৃতি
- জীবনানন্দ দাশ---ঝরা পালক
থমথমে রাত,- আমার পাশে বসল অতিথি,-
বললে,- আমি অতীত ক্ষুধা,-তোমার অতীত স্মৃতি!
-যে দিনগুলো সাঙ্গ হ’ল ঝড়বাদলের জলে,
শুষে গেল মেরুর হিমে,- মরুর অনলে,
ছায়ার মতো মিশেছিলাম আমি তাদের সনে;
তারা কোথায়?-বন্দি স্মৃতিই কাঁদছে তোমার মনে!
কাঁদছে তোমার মনের খাকে,- চাপা ছাইয়ের তলে,
কাঁদছে তোমার স্যাঁতস্যাঁতে শ্বাস-ভিজা চোখের জলে,
কাঁদছে তোমার মূক মমতার রিক্ত পাথার ব্যেপে,
তোমার বুকের খাড়ার কোপে,- খুনের বিষে ক্ষেপে!
আজকে রাতে কোন্ সে সুদূর ডাক দিয়েছে তারে,-
থাকবে না সে ত্রিশূলমূলে, শিবের দেউলদ্বারে!
মুক্তি আমি দিলেম তারে,-উল্লাসেতে দুলে
স্মৃতি আমার পালিয়ে গেল বুকের কপাট খুলে
নবালোকে,-নবীন উষার নহবতের মাঝে।
ঘুমিয়েছিলাম,- দোরে আমার কার করাঘাত বাজে!
-আবার আমায় ডাকলে কেন স্বপনঘোরের থেকে!
ওই লোকালোক-শৈলচূড়ায় চরণখানা রেখে
রয়েছিলাম মেঘের রাঙা মুখের পানে চেয়ে,
কোথার থেকে এলে তুমি হিমসরণি বেয়ে!
ঝিম্ঝিমে চোখ,- জটা তোমার ভাসছে হাওয়ার ঝড়ে,
শ্মশানশিঙা বাজল তোমার প্রেতের গলার স্বরে!
আমার চোখের তারার সনে- তোমার আঁখির তারা
মিলে গেল,-তোমার মাঝে আবার হলেম হারা!
-হারিয়ে গেলাম ত্রিশূলমূলে,- শিবের দেউলদ্বারে;
কাঁদছে স্মৃতি-কে দেবে গো-মুক্তি দেবে তারে!
যে কামনা নিয়ে
- জীবনানন্দ দাশ---ঝরা পালক
যে কামনা নিয়ে মধুমাছি ফেরে বুকে মোর সেই তৃষা!
খুঁজে মরি রূপ, ছায়াধূপ জুড়ি,
রঙের মাঝারে হেরি রঙডুবি!
পরাগের ঠোঁটে পরিমল-গুঁড়ি,-
হারায়ে ফেলি গো দিশা!
আমি প্রজাপতি-মিঠা মাঠে মাঠে সোঁদালে সর্ষেক্ষেতে;
-রোদের সফরে খুঁজি নাকো ঘর,
বাঁধি নাকো বাসা-কাঁপি থরথর।
অতসী ছুঁড়ির ঠোঁটের উপর
শুঁড়ির গেলাসে মেতে!
আমি দক্ষিণা-দুলালীর বীণা,পউষ-পরশ-হারা!
ফুল-আঙিয়ার আমি ঘুমভাঙা!
পিয়াল চুমিয়া পিলাই গো রাঙা
পিয়ালার মধু,- তুলি রাতজাগা
হোরীর হা রা রা সাড়া!
আমি গো লালিমা,-গোধূলির সীমা,- বাতাসের ‘লাল’ ফুল।
দুই নিমেষের তরে আমি জ্বালি
নীল আকাশের গোলাপী দেয়ালি!
আমি খুশরোজী,-আমি গো খেয়ালি,
চঞ্চল,- চুলবুল।
বুকে জ্বলে মোর বাসর দেউটি,-মধু-পরিণয়-রাতি!
তুলিছে ধরণী বিধবা-নয়ন
-মনের মাঝারে মদনমোহন
মিলননদীর নিধুর কানন
রেখেছে রে মোর পাতি !
দক্ষিণা
- জীবনানন্দ দাশ---ঝরা পালক
প্রিয়ার গালেতে চুমো খেয়ে যায় চকিতে পিয়াল রেণু!-
এল দক্ষিণা,-কাননের বীণা,- বনানীপথের বেণু!
তাই মৃগী আজ মৃগের চোখেতে বুলায়ে নিতেছে আখিঁ,
বনের কিনারে কপোত আজিকে নেয় কপোতীরে ডাকি!
ঘুঘুর পাখায় ঘুঙুর বাজায় আজিকে আকাশখানা,-
আজ দখিনার ফর্দা হাওয়ায় পর্দা মানে না মানা!
শিশিরশীর্ণা বালার কপোলে কুহেলির কালো জাল
উষ্ণ চুমোর আঘাতে হয়েছে ডালিমের মতো লাল!
দাড়িমের বীজ ফাটিয়া পড়িছে অধরের চারিপাশে
আজ মাধবীর প্রথম উষার,- দখিনা হাওয়ার শ্বাসে!
মদের পেয়ালা শুকায়ে গেছিল,- উড়ে গিয়েছিল মাছি,
দখিনাপরশে ভরা পেয়ালায় বুদবুদ্ ওঠে নাচি!
বেয়ালার সুরে বাজিয়া উঠিছে শিরা-উপশিরাগুলি!
শ্মাশানের পথে করোটি হাসিছে,-হেসে খুন হ’ল খুলি!
এস্রাজ বাজে আজ মলয়ের,- চিতার রৌদ্রাতপ
সুরের সুঠামে নিভে যায় যেন,- হেসে ওঠে যেন শব!
নিভে যায় রাঙা অঙ্কারমালা,- বৈতরনীর জলে,
সুর-জাহ্নবী ফুটে ওঠে আজ মলয়ের কোলাহলে!
আকাশ- শিথানে মধু- পরিণয়,-মিলন- বাসর পাতি
হিমানীশীর্ণ বিধবা তারারা জ্বলে ওঠে রাতারাতি!
ফাগুয়ার রাগে চাঁদের কপোল চকিতে হয়েছে রাঙা!
-হিমের ঘোমটা চিরে দেয় কে গো মরমস্নায়ুতে দাঙা!
লালসে কাহার আজ নীলিমার আনন রুধির- লাল,-
নিখিলের গালে গাল পাতে কার কুঙ্কুম- ভাঙা গাল!
নারাঙ্গি- ফাটা অধর কাহার আকাশ বাতাসে ঝরে!
কাহার বাঁশিটি খুন উথলায়,- পরান উদাস করে!
কাহার পানেতে ছুটিছে উধাও শিশুপিয়ালের শাখা!
ঠোঁটে ঠোঁট ডলে- পরাগ চোঁয়ায় অশোকফুলের ঝাঁকা!
কাহার পরশে পলাশ-বধূর আঁখির কেশরগুলি
মুদে মুদে আসে,-আর বার করে কুঁদে কুঁদে কোলাকুলি!
পাতার বাজারে বাজে হুল্লোড়,-পায়েলার রুণ রুণ,
কিশলয়দের ডাঁশা পেষে কে গো-চোখ করে ঘুম-ঘুম!
এসেছে দখিনা-ক্ষীরের মাঝারে লুকায়ে কোন্ এক হীরের ছুরি!-
তার লাগি তবু ক্ষ্যপা শাল নিম, তমাল- বকুলে হুড়াহুড়ি!
আমের কুঁড়িতে বাউল বোলতা খুনসুড়ি দিয়ে খসে যায়,
অঘ্রাণে যার ঘ্রাণ পেয়েছিল,- পেয়েছিল যারে ‘পোষলা’য়,
সাতাশে মাঘের বাতাসে তাহার দর বেড়ে গেছে দশগুণ,-
নিছক হাওয়ায় ঝরিয়া পড়িছে আজ মউলের কষ গুণ!
ঠেলে ফেলে দিয়ে নীলমাছি আর প্রজাপতিদের ভিড়
দখিনার মুখে রসের বাগান বিকায়ে দিতেছে ক্ষীর!
এসেছে নাগর,- যামিনীর আজ জাগর রঙিন আঁখি,-
কুয়াশার দিনে কাঁচুলি বাঁধিয়া কুচ রেখেছিল ঢাকি,-
আজিকে কাঞ্চী যেতেছে খুলিয়া,- মদঘূর্ণনে হায়!
নিশীথের স্বেদ-সীধুধারা আজ ক্ষরিছে দক্ষিণায়!
রূপসী ধরনী বাসকসজ্জা,- রূপালি চাঁদের তলে
বালুর ফরাশে রাঙা উল্লাসে ঢেউয়ের আগুন জ্বলে!
রোল উতরোল শোণিতে শিরায়,- হোরীর হা রা রা চিৎকার,-
মুখে মুখে মধু,- সুধাসীধু শুধু,- তিত্ কোথা আজ- তিত্ কার!
শীতের বাস্তুভিত ভেঙে আজ এল দক্ষিণা,- মিষ্টি- মধু,
মদনের হুলে ঢুলে ঢুলে ঢুলে হুশ-হারা হ’ল সৃষ্টি- বধূ!
চাঁদিনীতে
- জীবনানন্দ দাশ---ঝরা পালক
বেবিলোন কোথা হারায়ে গিয়েছে,-মিশর-‘অসুর’ কুয়াশাকালো;
চাঁদ জেগে আছে আজো অপলক,- মেঘের পালকে ঢালিছে আলো!
সে যে জানে কত পাথারের কথা,- কত ভাঙা হাট মাঠের স্মৃতি!
কত যুগ কত যুগান্তরের সে ছিল জ্যোৎস্না, শুক্লাতিথি!
হয়তো সেদিনো আমাদেরি মতো পিলুবারোয়াঁর বাঁশিটি নিয়া
ঘাসের ফরাশে বসিত এমনি দূর পরদেশী প্রিয় ও প্রিয়া!
হয়তো তাহারা আমাদেরই মতো মধু-উৎসবে উঠিত মেতে
চাঁদের আলোয় চাঁদমারী জুড়ে,- সবুজ চরায়,- সবজি ক্ষেতে!
হয়তো তাহার দুপুর- যামিনী বালুর জাজিমে সাগরতীরে
চাঁদের আলোয় দিগদিগন্তে চকোরের মতো চরিত ফিরে !
হয়তো তাহারা মদঘূর্ণনে নাচিত কাঞ্চীবাধঁন খুলে
এম্নি কোন এক চাঁদের আলোয়,-মরু- ‘ওয়েসিসে’ তরুর মূলে!
বীর যুবাদল শত্রুর সনে বহুদিনব্যাপী রণের শেষে
এম্নি কোন এক চাঁদিনীবেলায় দাঁড়াত নগরীতোরণে এসে!
কুমারীর ভিড় আসিত ছুটিয়া, প্রণয়ীর গ্রীবা জড়ায়ে নিয়া
হেঁটে যেত তারা জোড়ায় জোড়ায় ছায়াবীথিকার পথটি দিয়া!
তাদের পায়ের আঙুলের ঘায়ে খড়- খড় পাতা উঠিত বাজি,
তাদের শিয়রে দুলিত জ্যোৎস্না- চাঁচর চিকন পত্ররাজি!
দখিনা উঠিত মর্মরি মধুবনানীর লতা-পল্লব ঘিরে,
চপল মেয়েরা উঠিত হাসিয়া,-‘এল বল্লভ,-এল রে ফিরে!’
-তুমি ঢুলে যেতে, দশমীর চাঁদ তাহাদের শিরে সারাটি নিশি,
নয়নে তাদের দুলে যেতে তুমি,-চাঁদিনী-শরাব,- সুরার শিশি!
সেদিনো এম্নি মেঘের আসরে জ্বলছে পরীর বাসরবাতি,
হয়তো সেদিনো ফুটেছে মোতিয়া,-ঝরেছে চন্দ্রমল্লীপাঁতি!
হয়তো সেদিনো নেশাখোর মাছি গুমরিয়া গেছে আঙুরবনে,
হয়তো সেদিনো আপেলের ফুল কেপেঁছে আঢুল হাওয়ার সনে!
হয়তো সেদিনো এলাচির বন আতরের শিশি দিয়েছে ঢেলে,
হয়তো আলেয়া গেছে ভিজা মাঠে এমনি ভূতুরে প্রদীপ জ্বেলে !
হয়তো সেদিনো ডেকেছে পাপিয়া কাঁপিয়া কাঁপিয়া ‘সরো’র শাখে,
হয়তো সেদিনো পাড়ার নাগরী ফিরেছে এমনি গাগরি কাঁখে!
হয়তো সেদিনো পানসী দুলায়ে গেছে মাঝি বাকাঁ ঢেউটি বেয়ে,
হয়তো সেদিনো মেঘের শকুনডানায় গেছিল আকাশ ছেয়ে!
হয়তো সেদিনো মানিকজোড়ের মরা পাখাটির ঠিকানা মেগে
অসীম আকাশে ঘুরেছে পাখিনী ছট্ফট্ দুটি পাখার বেগে!
হয়তো সেদিনো খুর খুর ক’রে খরগোশছানা গিয়েছে ঘুরে
ঘন-মেহগিনি- টার্পিন- তলে- বালির জর্দা বিছানা ফুঁড়ে!
হয়তো সেদিনো জানালার নীল জাফরির পাশে একেলা বসি
মনের হরিনী হেরেছে তোমারে-বনের পারের ডাগর শশী!
শুক্লা একাদশীর নিশীথে মণিহরমের তোরণে গিয়া
পারাবত-দূত পাঠায়ে দিয়েছে প্রিয়ের তরেতে হয়তো প্রিয়ো!
অলিভকুঞ্জে হা হা ক’রে হাওয়া কেঁদেছে কাতর যামিনী ভরি!
ঘাসের শাটিনে আলোর ঝালরে ‘মার্টিল’ পাতা প’ড়েছে ঝরি!
‘উইলো’র বন উঠেছে ফুঁপায়ে,-‘ইউ’ তরুশাখা গিয়েছে ভেঙে,
তরুনীর দুধ-ধবধবে বুকে সাপিনীর দাঁত উঠেছে রেঙে!
কোন্ গ্রীস,- কোন্ কার্থেজ, রোম, ‘ত্রুবেদু’র- যুগ কোন,-
চাঁদের আলোয় স্মৃতির কবর- সফরে বেড়ায় মন!
জানি না তো কিছু,-মনে হয় শুধু এম্নি তুহিন চাঁদের নিচে
কত দিকে দিকে-কত কালে কালে হ’য়ে গেছে কত কী যে!
কত যে শ্মশান,-মশান কত যে,-কত যে কামনা- পিপাস-আশা
অস্তচাঁদের আকাশে বেঁধেছে আরব-উপন্যাসের বাসা!
মরুবালু
- জীবনানন্দ দাশ---ঝরা পালক
হাড়ের মালা গলায় গেঁথে – অট্টহাসি হেসে
উল্লাসেতে টলছে তারা,- জ্বলছে তারা খালি !
ঘুরছে তারা লাল মশানে কপাল- কবর ঘেঁসে ,
বুকের বোমাবারুদ দিয়ে আকাশটারে জ্বালি
পাঁয়জোরে কাল মহাকালের পাঁজর ফেড়ে ফেড়ে
মড়ার বুকে চাবুক মেরে ফিরছে মরুর বালি !
সর্বনাশের সঙ্গে তোরা দম্ভে খেলিস পাশা
হেথায় কোন এক সৃষ্টিপাতের সূত্রপাতের ভূমি ,
-শিশু মানব গড়েছিল ঐ সাহারায় বাসা ;
- সে সব গেছে কবে ঘুমের চুমার ধোঁয়ায় ধূমি !
অটল আকাশ যাচ্ছে জরির ফিতার মতো ফেড়ে ,
জবান তোদের জ্বলছে যমের চিতার গেলাস চুমি !
তোদের সনে ‘ডাইনোসুরে’র লড়াই হলো কত,-
আলুথালু লুটিয়ে বালুর ডাইনী ছায়ার তলে
আজকে তারা ঘুমিয়া আছে ,- চুল্লি শত শত
উঠলো জ্বলে তাদের হাড়ে ,- তাদের নাড়ের বলে ;
কাঁদছে খাঁ খাঁ কাফন-ঢাকা বালুর চাকার নিচে ,
মুণ্ড তাদের ,- মড়ার কপাল ভৈরবেরি গলে!
তোদের বুকে জাগছে মৃগতৃষ্ণা ,- জাগে ঝর!
নিস উড়িয়ে শিকার- সোয়ার ধোঁয়ার পিছে পিছে ,-
মেঘে মেঘে চড়াও ,- বাজের বুক চিরে চক্কর !
নাচতে আছিস আকাশখানার গোখরাফণার নিচে,
আরব মিশর চীন ভারতের হাওয়ায় ঘুরে ঘুরে !
সত্য ত্রেতা দ্বাপর কলি হাপর খিঁচে খিঁচে !
তোদের ভাষা আস্ফালিছে শেখ সেনানীর বুকে!
-লাল সাহারার শেরের সোয়ার ,- বালুর ঘায়ে ঘেয়ো ,
ধমক মেরে আঁধির বুকে ছুটছে রুখে রুখে!
-তোদের মতো নেইকো তাদের সোদর- সাথী কেহ ,
নেইকো তাদের মোদের মতন পিছুডাকের মায়া,
নেইকো তাদের মোদের মতন আর্ত মোহ-স্নেহ !
দানোয়-পাওয়া আগুনদানা ,- দারুণ পথের মুখে !
ঘায়েল করি মেঘের বুরুজ বল্লমেরি ঘর,
উড়িয়া হাজার ‘ক্যারাভেন’ ও তাম্বুশিবির বুকে ,
উজিয়ে মরীচিকার শিখা – কালফণা জর্জর ,
-টলতে আছিস ,- দলতে আছিস ,- জ্বলতে আছিস ধূ ধূ !
সঙ্গে স্যাঙাত-মসুদ ডাকাত ,- তাতার যাযাবর !
গাড়তে যাবো যারা তোদের বুকের মাঝে বাসা
হাড্ডি তাদের ফোফরা হ’য়ে ঝুরবে বালুর মাঝে ,
এইখানেতে নেইকো দরদ,-নেইকো ভালোবাসা ,
বর্শা লাফায় ,- উটের গলায় ঘণ্টি শুধু বাজে !
ফুরিয়ে গেছে আশা যাদের,- জুড়িয়ে গেছে জ্বালা ,
আয় রে বালুর ‘কারবালা’তে, অন্ধকারের ঝাঁঝে !
পিরামিড
- জীবনানন্দ দাশ---ঝরা পালক
-বেলা বয়ে যায় !
গোধূলির মেঘ- সীমানায়
ধূম্র মৌন সাঁঝে
নিত্য নব দিবসের মৃত্যুঘণ্টা বাজে !
শতাব্দীর শব্দেহে শ্মশানের ভস্মবহ্নি জ্বলে!
পান্থ ম্লান চিতার কবলে
একে একে ডুবে যায় দেশ , জাতি,- সংসার, সমাজ ,
কার লাগি হে সমাধি, তুমি একা বসে আছ আজ
কী এক বিক্ষুব্ধ প্রেতকায়ার মতন !
অতীতের শোভাযাত্রা কোথায় কখন
চকিতে মিলায়ে গেছে- পাও নাই টের !
কোন দিবা অবসানে গৌরবের লক্ষ মুসাফের
দেউটি নিভায়ে গেছে ,- চলে গেছে দেউল ত্যজিয়া,
চলে গেছে প্রিয়তম,- চলে গেছে প্রিয়া !
যুগান্তের মণিময় গেহবাস ছাড়ি
চকিতে চলিয়া গেছে বাসনা-পসারী ,
কবে কোন বেলাশেষে হায়
দূর অস্তশেখরের গায় !
তোমারে যায়নি তারা শেষ অভিনন্দনের অর্ঘ্য সমরপিয়া ;
সাঁঝের নীহারনীল সমুদ্র মথিয়া
মরমে পশেনি তব তাহাদের বিদায়ের বাণী !
তোরণে আসেনি তব লক্ষ লক্ষ মরণ- সন্ধানী
অশ্রু-ছলছল চোখে,-পাণ্ডুর বদনে !
-কৃষ্ণ যবনিকা কবে ফেলে তারা গেল দূর দ্বারে বাতায়নে
জানো নাই তুমি !
জানো না তো মিশরের মূক মরুভূমি
তাদের সন্ধান !
হে নির্বাক পিরামিড ,- অতীতের স্তব্ধ প্রেত-প্রাণ
অবিচল স্মৃতির মন্দির !
আকাশের পানে চেয়ে আজো তুমি বসে আছো স্থির !
নিস্পলক যুগ্মভুরু তুলে
চেয়ে আছো অনাগত উদধির কূলে
মেঘ- রক্ত ময়ূখের পানে !
জ্বলিয়া যেতেছে নিত্য নিশি-অবসানে
নূতন ভাস্কর !
বেজে ওঠে অনাহত মেম্ননের স্বর
নবোদিত অরুণের সনে
কোন আশা- দুরাশার ক্ষণস্থায়ী অঙ্গুলি-তাড়নে !
-পিরামিড-পাষাণের মর্ম ঘেরি নেচে যায় দু’দণ্ডের
রুধির- ফোয়ারা
কি এক প্রগলভ উষ্ণ উল্লাসের সাড়া !
থেমে যায় পান্থবীণা মুহূর্তে কখন !
শতাব্দীর বিরহীর মন
নিটল নিথর
সন্তরি ফিরিয়া মরে গগনের রক্ত-পীত সাগরের’পর!
বালুকার স্ফীত পারাবারে
লোল মৃগতৃষ্ণিকার দ্বারে
মিশরের অপহৃত অন্তরের লাগি
মৌন ভিক্ষা মাগি
-খুলে যাবে কবে রুদ্ধ মায়ার দুয়ার !
মুখরিত প্রাণের সঞ্চার
ধ্বনিত হইবে কবে কলহীন নীলার বেলায় !
-বিচ্ছেদের নিশি জেগে আজো তাই বসে আছে
পিরামিড হায় !
-কত আগুন্তুক- কাল,- অতিথি – সভ্যতা
তোমার দুয়ারে এসে কয়ে যায় অসম্ব্রিত অন্তরের কথা!
তুলে যায় উচ্ছৃঙ্খল রুদ্র কোলাহল !
-তুমি রহ নিরুত্তর,- নির্বেদী ,- নিশ্চল !
মৌন , অন্যমনা !
-প্রিয়ার বক্ষের’পরে বসি একা নীরবে করিছ তুমি
শবের সাধনা
হে প্রেমিক-স্বতন্ত্র স্বরাট !
-কবে সুপ্ত উৎসবের স্তব্ধ ভাঙা হাট
উঠিবে জাগিয়া !
সস্মিত নয়ন তুলি কবে তব প্রিয়া
আঁকিবে চুম্বন তব স্বেদ- কৃষ্ণ , পাণ্ডু , চূর্ণ ,
ব্যথিত কপোলে !
মিশর- অলিন্দে কবে গরিমার দীপ যাবে জ্বলে !
বসে আছো অশ্রুহীন স্পন্দহীন তাই!
-ওলটিপালটি যুগ-যুগান্তের শ্মশানের ছাই
জাগিয়া রয়েছে তব প্রেত-আঁখি ,- প্রেমের প্রহরা!
-মোদের জীবনে যবে জাগে পাতা -ঝরা
হেমন্তের বিদায় – কুহেলি ,
অরুন্তুদ আঁখি দুটি মেলি
গড়ি মোরা স্মৃতির শ্মশান
দুদিনের তরে শুধু,- নবোৎফুল্লা মাধবীর গান
মোদের ভুলায়ে নেয় বিচিত্র আকাশে
নিমেষে চকিতে !
-অতীতের হিমগর্ভ কবরের পাশে
ভুলে যাই দুই ফোঁটা অশ্রু ঢেলে দিতে !
মিশর
- জীবনানন্দ দাশ---ঝরা পালক
‘মমী’র দেহ বালুর তিমির জাদুর ঘরে লীন,-
‘স্ফীঙ্ক্স’-দানবীর অরাল ঠোঁটের আলাপ আজি চুপ!
ঝাঁ ঝাঁ মরুর ‘লু’য়ের ‘ফুঁ’য়ে হছে বিলীন-ক্ষীণ
মিশর দেশের কাফন্ পাহাড়-পিরামিডের স্তূপ!
নিভে গেছে ‘ঈশিশে’রি বেদীর থেকে ধূমা,
জুড়িয়ে গেছে লক্লকে সেই রক্তজিভার চুমা!
এদ্দিনেতে ফুরিয়ে গেছে কুমিরপূজার ঘটা,
দুলছে মরুমশান- শিরে মহাকালের জটা!
ঘুমন্তদের কানে কানে কয় সে,-‘ঘুমা,- ঘুমা!’
ঘুমিয়ে গেছে বালুর তলে ফ্যারাও,- ফ্যারাও ছেলে,-
তাদের বুকে যাচ্ছে আকাশ বর্শা ঠেলে ঠেলে!
হাওয়ার সেতার দেয় ফুঁপিয়ে ‘মেম্ননে’রি বুক,
ডুবে গেছে মিশররবি-বিরাট ‘বেলে’র ভুখ
জিহ্বা দিয়ে জঠর দিয়ে গেছে তোমার জ্বেলে!
পিরাপিডের পাশাপাশি লালচে বালুর কাছে
স্থবির মরণ-ঘুমের ঘোরে মিশর শুয়ে আছে!
সোনার কাঠি নেই কি তাহার? জাগবে নাকি আর!
মৃত্যু,- সে কি শেষের কথা?- শেষ কি শবাধার?
সবাই কি গো ঢালাই হবে চিতার কালির ছাঁচে!
নীলার ঘোলা জলের দোলায় লাফায় কালো সাপ।
কুমিরগুলোর খুলির খিলান,- করাত দাঁতের খাপ
উর্ধ্বমুখে রৌদ্র পোহায়;- ঘুমপাড়ানির ঘুম
হানছে আঘাত,-আকাশবাতাস হচ্ছে যেন গুম্!
ঘুমের থেকে উপচে পড়ে মৃতের মনস্তাপ!
নীলা, নীলা,- ধুক্ধুকিয়ে মিশরকবর- পারে
রইলে জেগে বোবাবুকের বিকল হাহাকারে
লাল আলেয়ার খেয়া ভাসায় ‘রামেসেসে’র দেশ!
অতীত অভিশাপের নিশা এলিয়ে এলোকেশ
নিভিয়ে দেছে দেউটি তোমার দেউল-কিনারে!
কলসি কোলে নীলনদেতে যেতেছে ঐ নারী,
ঐ পথেতে চলতে আছে নিগ্রো সারি সারি;
ইয়াঙ্কী ঐ,- ঐ য়ুরোপী,-চীনে-তাতার মুর
তোমার বুকের পাঁজর দ’লে টলতেছে হুড়মুড়্,-
ফেনিয়ে তুলে খুন্খারাবি্- খেলাপ,- খবরদারি!
দিনের আলো ঝিমিয়ে গেল,-আকাশে ঐ চাঁদ!
-চপল হাওয়ায় কাঁকন কাঁদায় নীলনদেরি বাঁধ!
মিশর- ছুঁড়ি গাইছে মিঠা শুঁড়িখানার সুরে
বালুর খাতে, প্রিয়ের সাথে,- খেজুরবনে দূরে!
আফ্রিকা এই,- এই যে মিশর,-জাদুর এ যে ফাঁদ!
‘ওয়েসিসে’র ঠান্ডা ছায়ায় চৈতিচাঁদের তলে
মিশরবালার বাঁশির গলা কিসের কথা বলে!
চলছে বালুর চড়াই ভেঙে উটের পরে উট,-
এই যে মিশর,-আফ্রিকার এই কুহকপাখাপুট!
-কী এক মোহ এই হাওয়াতে,- এই দরিয়ার জলে!
শীতল পিরামিডের মাথা,-‘গীজে’র মূরতি
অঙ্কবিহীন যুগসমাধির মূক মমতা মথি
আবার যেন তাকায় অদূর উদয়গিরির পানে!
মেম্ননে’র ঐ কন্ঠ ভরে চারণ-বীনার গানে!
আবার জাগে ঝান্ডাঝালর,- জ্যান্ত আলোর জ্যোতি!
শ্মশান
- জীবনানন্দ দাশ---ঝরা পালক
কুহেলির হিমশয্যা অপসারি ধীরে
রূপময়ী তন্বী মাধবীরে
ধরণী বরিয়া লয় বারে-বারে-বারে!
-আমাদের অশ্রুর পাথারে
ফুটে ওঠে সচকিতে উৎসবের হাসি,
অপরূপ বিলাসের বাঁশি!
ভগ্ন- প্রতিমারে মোরা জীবনের বেদীতটে আরবার গড়ি,
ফেনাময় সুরাপাত্র ধরি
ভুলে যাই বিষের আস্বাদ!
মোহময় যৌবনের সাধ
আতপ্ত করিয়া তোলে স্থবিরের তুহিন- অধর!
চির-মৃত্যুচর
হে মৌন শ্মশান,
ধূম-অবগুন্ঠনের অন্ধকারে আবরি বয়ান
হেরিতেছ কিসের স্বপন!
ক্ষণে ক্ষণে রক্তবহ্নি করি নির্বাপন
স্তব্ধ করি রাখিতেছ বিরহীর ক্রন্দনের ধ্বনি!
তবু মুখ-পানে চেয়ে কবে বৈতরণী
হ’য়ে গেছে কলহীন!
বক্ষে তব হিম হ’য়ে আছ কত উগ্রশিখা চিতা
হে অনাদি পিতা!
ভস্মগর্ভে,- মরণের অকূল শিয়রে
জন্মযুগ দিতেছ প্রহরা,-
কবে বসুন্ধরা
মৃত্যুগাঢ় মদিবার শেষ পাত্রখানি
তুলে দেবে হস্তে তব,- কবে লবে টানি
কাঙ্কাল- আঙ্গুলি তুলি শ্যামা ধরণীরে
শ্মশান-তিমিরে,
লোলুপ নয়ন মেলি হেরিবে তাহার বিবসনা শোভা
দিব্য মনোলোভা!
কোটি কোটি চিতা-ফণা দিয়া
রূপসীর অঙ্গ-আলিঙ্গিয়া
শুষে নেবে সৌন্দর্যের তামরস-মধু!
এ বসুধা-বধূ
আপনারে ডারি দেবে উরসে তোমার!
ধ্বক্-ধ্বক্-দারুণ তৃষ্ণার
রসনা মেলিয়া-
অপেক্ষায় জেগে আছে শ্মশানের হিয়া!
আলোকে- আঁধারে
অগণন চিতার দুয়ারে
যেতেছে সে ছুটে,
তৃপ্তিহীন তিক্ত বক্ষপুটে
আনিতেছে নব- মৃত্যু- পথিকেরে ডাকি,
তুলিতেছে রক্ত-ধুম্র- আঁখি!
-নিরাশার দীর্ঘশ্বাস শুধু
বৈতরণীমরু ঘেরি জ্বলে যায় ধূ ধূ,
আসে না প্রেয়সী!
-নিদ্রাহীন শশী,
আকাশের অনাদি তারকা,
রহিয়াছে জেগে তার সনে;
শ্মশানের হিম বাতায়নে
শত শত প্রেতবধূ দিয়া যায় দেখা,-
তবু সে যে প’ড়ে আছে একা,
বিমনা-বিরহী!
বক্ষে তার কত লক্ষ সভ্যতার স্মৃতি গেছে দহি,
কত শৌর্য-সাম্রাজ্যের সীমা
প্রেম-পুণ্য-পূজার গরিমা
অকলঙ্ক সৌন্দর্যের বিভা
গৌরবের দিবা!
-তবু তার মেটে নাই তৃষা;
বিচ্ছেদের নিশা
আজো তার হয় নাই শেষ!
অশ্রান্ত অঙ্গুলি সে যে করিছে নির্দেশ
অবনীর পক্ববিম্ব অধরের’ পর!
পাতাঝরা হেমন্তের স্বর
ক’রে দেয় সচকিত তারে,
হিমানী-পাথারে
কুয়াশাপুরীর মৌন জালায়ন তুলে
চেয়ে থাকে আঁধারে অকূলে
সুদূরের পানে!
বৈতরণীখেয়াঘাটে মরণ-সন্ধানে
এল কি রে জাহ্নবীর শেষ ঊর্মিধারা!
অপার শ্মশান জুড়ি জ্বলে লক্ষ চিতাবহ্নি,-কামনা-সাহারা!
ডাহুকী
- জীবনানন্দ দাশ---ঝরা পালক
মালঞ্চে পুষ্পিত লতা অবনতমুখী,-
নিদাঘের রৌদ্রতাপে একা সে ডাহুকী
বিজন- তরুর শাখে ডাকে ধীরে ধীরে
বনচ্ছায়া- অন্তরালে তরল তিমিরে!
-আকাশে মন্থর মেঘ, নিরালা দুপুর!
-নিস্তব্ধ পল্লীর পথে কুহকের সুর
বাজিয়া উঠিছে আজ ক্ষণে ক্ষণে ক্ষণে!
সে কোন পিপাসা কোন ব্যথা তার মনে!
হারায়েছে প্রিয়ারে কি?- অসীম আকাশে
ঘুরেছে অনন্ত কাল মরীচিকা-আশে?
বাঞ্ছিত দেয়নি দেখা নিমেষের তরে!-
কবে কোন রুক্ষ কাল- বৈশাখীর ঝড়ে
ভেঙে গেছে নীড়, গেছে নিরুদ্দেশে ভাসি!
-নিঝুম বনের তটে বিমনা উদাসী
গেয়ে যায়; সুপ্ত পল্লী-তটিনীর তীরে
ডাহুকীর প্রতিধ্বনি-ব্যথা যায় ফিরে!
-পল্লবে নিস্তব্ধ পিক,- নীরব পাপিয়া,
গাহে একা নিদ্রাহারা বিরহিণী হিয়া!
আকাশে গোধূলি এল,-দিক্ হ’ল ম্লান,
ফুরায় না তবু হায় হুতাশীর গান!
-স্তিমিত পল্লীর তটে কাঁদে বারবার,
কোন্ যেন সুনিভৃত রহস্যের দ্বার
উন্মূক্ত হল না আর কোন্ সে গোপান
নিল না হৃদয়ে তুলি তার নিবেদন!
পতিতা
- জীবনানন্দ দাশ---ঝরা পালক
আগার তাহার বিভীষিকাভরা,- জীবন মরণময়!
সমাজের বুকে অভিশাপ সে যে, – সে যে ব্যাধি,- সে যে ক্ষয়;
প্রেমের পসরা ভেঙে ফেলে দিয়ে ছলনার কারাগার
রচিয়াছে সে যে,-দিনের আলোয় রুদ্ধ ক’রেছে দ্বার!
সূর্যকিরণ চকিতে নিভায়ে সাজিয়াছে নিশাচর,
কালনাগিনীর ফনার মতন নাচে সে বুকের’ পর!
চক্ষে তাহার কালকুট ঝরে,- বিষপঙ্কিল শ্বাস,
সারাটি জীবন মরীচিকা তার,- প্রহসন-পরিহাস!
ছোঁয়াচে তাহার ম্লান হ’য়ে যায় শশীতারকার শিখা,
আলোকের পারে নেমে আসে তার আঁধারের যবনিকা!
সে যে মন্বন্তর,- মৃত্যুর দূত,- অপঘাত,- মহামারী,-
মানুষ তবু সে,- তার চেয়ে বড়, – সে যে নারী, সে যে নারী!
নিখিল আমার ভাই
- জীবনানন্দ দাশ---ঝরা পালক
নিখিল আমার ভই,
-কীটের বুকেতে যেই ব্যথা জাগে আমি সে বেদনা পাই;
যে প্রাণ গুমরি কাঁদিছে নিরালা শুনি যেন তার ধ্বনি,
কোন্ ফণী যেন আকাশে বাতাসে তোলে বিষ- গরজনি!
কী যেন যাতনা মাটির বুকেতে আনিবার ওঠে রণি,
আমার শস্য-স্বর্ণসরা নিমেষে হয় যে ছাই!
-সবার বুকের বেদনা আমার, নিখিল আমার ভাই।
আকাশ হতেছে কালো,
কাহাদের যেন ছায়াপাতে হায়, নিভে যায় রাঙা আলো!
বাতায়নে মোর ভেসে আসে যেন কাদের তপ্ত শ্বাস,
অন্তরে মোর জড়ায়ে কাদের বেদনার নাগপাশ,
বক্ষে আমার জাগিছে কাদের নিরাশা, গ্লানিমা, ত্রাস,
-মনে মনে আমি কাহাদের হায় বেসেছিনু এত ভালো!
তাদের ব্যথার কুহেলি- পাথারে আকাশ হতেছে কালো।
লভিয়াছে বুঝি ঠাঁই
আমার চোখের অশ্রুপুঞ্জে নিখিলের বোন-ভাই!
আমার গানেতে জাগিছে তাদের বেদনা-পীড়ার দান,
আমার প্রাণেতে জাগিছে তাদের নিপীড়িত ভগবান,
আমার হৃদয়-যূপেতে তাহারা করিছে রক্তস্নান,
আমার মনের চিতানলে জ্ব’লে লুটায়ে যেতেছে ছাই!
আমার চোখের অশ্রুপুঞ্জে লভিয়াছে তারা ঠাঁই।
হিন্দু-মুসলমান
- জীবনানন্দ দাশ---ঝরা পালক
মহামৈত্রীর বরদ-তীর্থে-পুণ্য ভারতপুরে
পূজার ঘন্টা মিশিছে হরষে নমাজের সুরে সুরে!
আহ্নিক হেথা শুরু হয়ে যায় আজান বেলার মাঝে,
মুয়াজ্জেনের উদাস ধ্বনিটি গগনে গগনে বাজে,
জপে ঈদগাতে তসবি ফকির, পূজারী মন্ত্র পড়ে,
সন্ধ্যা-উষার বেদবাণী যায় মিশে কোরানের স্বরে;
সন্ন্যাসী আর পীর
মিলে গেছে হেথা,-মিশে গেছে হেথা মসজিদ , মন্দির!
কে বলে হিন্দু বসিয়া রয়েছে একাকী ভারত জাঁকি?
-মুসলমানের হস্তে হিন্দু বেঁধেছে মিলন-রাখী;
আরব মিশর তাতার তুর্কী ইরানের চেয়ে মোরা
ওগো ভারতের মোসলেমদল,- তোমাদের বুক-জোড়া!
ইন্দ্রপ্রস্থ ভেঙেছি আমরা,- আর্যাবর্ত ভাঙি
গড়েছি নিখিল নতুন ভারত নতুন স্বপনে রাঙি!
-নবীন প্রাণের সাড়া
আকাশে তুলিয়া ছুটিছে মুক্ত যুক্তবেণীর ধারা!
রুমের চেয়েও ভারত তোমার আপন,- তোমার প্রাণ!
-হেথায় তোমার ধর্ম অর্থ,- হেথায় তোমার ত্রাণ;
হেথায় তোমার আসান ভাই গো, হেথায় তোমার আশা;
যুগ যুগ ধরি এই ধূলিতলে বাঁধিয়াছ তুমি বাসা,
গড়িয়াছ ভাষা কল্পে কল্পে দরিয়ার তীরে বসি,
চক্ষে তোমার ভারতের আলো,-ভারতের রবি, শশী,
হে ভাই মুসলমান,
তোমাদের তরে কোল পেতে আছে ভারতের ভগবান!
এ ভারতভূমি নহেকো তোমার, নহকো আমার একা,
হেথায় পড়েছে হিন্দুর ছাপ,- মুসলমানের রেখা;
-হিন্দু মনীষা জেগেছে এখানে আদিম উষার ক্ষণে,
ইন্দ্রদ্যুম্নে উজ্জয়িনীতে মথুরা বৃন্দাবনে!
পাটলিপুত্র শ্রাবস্তী কাশী কোশল তক্ষশীলা।
অজন্তা আর নালন্দা তার রটিছে কীর্তিলীলা!
-ভারতী কমলাসীনা
কালের বুকেতে বাজায় তাহার নব প্রতিভার বীণা!
এই ভারতের তখতে চড়িয়া শাহানশাহার দল
স্বপ্নের মণি-প্রদীপে গিয়েছে উজলি আকাশতল!
-গিয়েছে তাহার কল্পলোকের মুক্তার মালা গাঁথি,
পরশে তাদের জেগেছে আরব- উপন্যাসের রাতি!
জেগেছে নবীন মোগল-দিল্লি,-লাহোর,-ফতেহপুর,
যমুনাজলের পুরানো বাঁশিতে বেজেছে নবীন সুর!
নতুন প্রেমের রাগে
তাজমহলের তরুণিমা আজো ঊষার আরুণে জাগে!
জেগেছে হেথায় আকবরী আইন,-কালের নিকষ কোলে
বারবার যার উজল সোনার পরশ উঠিল জ্বলে!
সেলিম,-শাজাহাঁ,- চোখের জলেতে এক্শা করিয়া তারা
গড়েছে মীনার মহলা স্তম্ভ কবর ও শাহদারা!
-ছড়ায়ে রয়েছে মোঘল ভারত,- কোটি সমাধির স্তূপ
তাকায়ে রয়েছে তন্দ্রাবিহীন,-অপলক অপরূপ!
-যেন মায়াবীর তুড়ি
স্বপনের ঘোরে ত্বব্ধ করিয়া রেখেছে কনকপুরী!
মোতিমহলের অযুত রাত্রি,- লক্ষ দীপের ভাতি
আজিও বুকের মেহেরাবে যেন জ্বালায়ে যেতেছে বাতি!
-আজিও অযুত বেগম-বাঁদীর শষ্পশয্যা ঘিরে
অতীত রাতের চঞ্চল চোখ চকিতে যেতেছে ফিরে!
দিকে দিকে আজো বেজে ওঠে কোন্ গজল-ইলাহী গান!
পথ-হারা কোন্ ফকিরের তানে কেঁদে ওঠে সারা প্রাণ!
-নিখিল ভারতময়
মুসলমানের স্বপন-প্রেমের গরিমা জাগিয়া রয়!
এসেছিল যারা ঊষর ধুসর মরুগিরিপথ বেয়ে,
একদা যাদের শিবিরে- সৈন্যে ভারত গেছিল ছেয়ে,
আজিকে তাহারা পড়শি মোদের,- মোদের বহিন-ভাই;
-আমাদের বুকে বক্ষে তাদের,-আমাদের কোলে ঠাঁই
‘কাফের’ ‘যবন’ টুটিয়া গিয়াছে,- ছুটিয়া গিয়াছে ঘৃণা,
মোস্লেম্ বিনা ভারত বিফল,- বিফল হিন্দু বিনা;
-মহামৈত্রীর গান
বাজিছে আকাশে নব ভারতের গরিমায় গরীয়ান!
বিবেকানন্দ
- জীবনানন্দ দাশ---ঝরা পালক
জয়,- তরুণের জয়!
জয় পুরোহিত আহিতাগ্নিক,- জয়,- জয় চিন্ময়!
স্পর্শে তোমার নিশা টুটেছিল,-উষা উঠেছিল জেগে
পূর্ব তোরণে, বাংলা-আকাশে ,-অরুণ-রঙিন মেঘে;
আলোকে তোমার ভারত,এশিয়া-জগৎ গেছিল রেঙে।
হে যুবক মুসাফের,
স্থবিরের বুকে ধ্বনিলে শ্ঙ্খ জাগরণপর্বের!
জিঞ্জির-বাঁধা ভীত চকিতেরে অভয় দানিলে আসি,
সুপ্তের বুকে বাজালে তোমার বিষাণ হে সন্ন্যাসী,
রুক্ষের বুকে বাজালে তোমার কালীয়-দমন বাঁশি!
আসিলে সব্যসাচী,
কোদন্ডে তব নব উল্লাসে নাচিয়া উঠিল প্রাচী!
টঙ্কারে তব দিকে দিকে শুধু রণিয়া উঠিল জয়,
ডঙ্কা তোমার উঠিল বাজিয়া মাভৈঃ মন্ত্রময়;
শঙ্কাহরণ ওহে সৈনিক,- নাহিকো তোমার ক্ষয়!
তৃতীয় নয়ন তব
ম্লান বাসনার মনসিজ নাশি জ্বালাইত উৎসব!
কলুষ-পাতকে, ধূর্জটি, তব পিনাক উঠিত রুখে,
হানিতে আঘাত দিবানিশি তুমি ক্লেদ-কামনার বুকে,
অসুর-আলয়ে শিব-সন্ন্যাসী বেড়াতে শঙ্খ ফুঁকে!
কৃষ্ণচক্র সম
ক্লৈব্যের হৃদে এসেছিলে তুমি ওগো পুরুষোত্তম,
এসেছিলে তুমি ভিখারীর দেশে ভিখারীর ধন মাগি
নেমেছিলে তুমি বাউলের দলে,- হে তরুণ বৈরাগী!
মর্মে তোমার বাজিত বেদনা আর্ত জীবের লাগি।
হে প্রেমিক মহাজন,
তোমার পানেতে তাকাইল কোটি দরিদ্র-নারায়ণ;
অনাথের বেশে ভগবান এসে তোমার তোরণতলে
বারবার যবে কেঁদে কেঁদে গেল কাতর আঁখির জলে,
অর্পিলে তব প্রীতি-উপায়ন প্রাণের কুসুমদলে।
কোথা পাপী? তাপী কোথা?
-ওগো ধ্যানী, তুমি পতিত-পাবন যজ্ঞে সাজিলে হোতা!
শিব-সুন্দর-সত্যের লাগি শুরু করে দিলে হোম,
কোটি পঞ্চমা আতুরের তরে কাঁপায়ে তুলিলে ব্যোম,
মন্ত্রে তোমার বাজিল বিপুল শানি স্বস্তি ওঁ!
সোনার মুকুট ভেঙে
ললাট তোমার কাঁটার মুকুটে রাখিলে সাধক রেঙে!
স্বার্থ লালসা পাসরি ধরিলে আত্মাহুতির ডালি,
যঞ্জের যূপে বুকের রুধির অনিবার দিলে ঢালি,
বিভাতি তোমার তাই তো অটুট রহিল অংশুমালী!
দরিয়ার দেশে নদী!
-বোধিসত্ত্বের আলয়ে তুমি গো নবীন শ্যামল বোধি!
হিংসার রণে আসিলে পথিক প্রেম-খঞ্জর হাতে,
আসিলে করুণা-প্রদীপ হস্তে হিংসার অমারাতে,
ব্যাধি মন্বন্তরে এলে তুমি সুধা-জলধরি সংঘাতে!
মহামারী ক্রন্দন
ঘুটাইলে তুমি শীতল পরশে, ওগো সুকোমল চন্দন!
বজ্র-কঠোর, কুসুম-মৃদুল,- আসিলে লোকোত্তর;
হানিলে কুলিশ কখনো,- ঢালিলে নির্মল নির্ঝর,
নাশিলে পাতক,-পাতকীরে তুমি অর্পিলে নির্ভর।
চক্র গদার সাথে
এনেছিলে তুমি শঙ্খ পদ্ম,- হে ঋষি, তোমার হাতে;
এনেছিলে তুমি ঝড় বিদ্যুৎ- পেয়েছিলে তুমি সাম,
এনেছিলে তুমি রণ-বিপ্লব,-শানি- কুসুম-দাম;
মাভৈঃ শঙ্খে জাগিছে তোমার নর-নারায়ণ-নাম!
জয়,- তরুণের জয়!
আত্মহুতির রক্ত কখনো আঁধারে হয় না লয়!
তাপসের হাড় বজ্রের মতো বেজে উঠে বারবার!
নাহি রে মরণে বিনাশ, -শ্মশানে নাহি তার সংহার,
দেশে দেশে তার বীণা বাজে-বাজে কালে কালে ঝঙ্কার!
দেশবন্ধু
- জীবনানন্দ দাশ---ঝরা পালক
বাংলার অঙ্গনেতে বাজায়েছ নটেশের রঙ্গমল্লী গাঁথা
অশান্ত সন্তান ওগো,- বিপ্লবিনী পদ্মা ছিল তব নদী-মাতা।
কালবৈশাখীর দোলা অনিবার দুলাইতে রক্তপুঞ্জ তব
উত্তাল ঊর্মির তালে,-বক্ষে তবু লক্ষ কোটি পন্নগ-উৎসব
উদ্যত ফণার নৃত্যে আষ্ফালিত ধূর্জটির কন্ঠ-নাগ জিনি,
ত্র্যম্বক-পিনাকে তব শঙ্কাকুল ছিল সদা শত্রু অক্ষৌহিণী।
স্পর্শে তব পুরোহিত, ক্লেদে প্রাণ নিমেষেতে উঠিত সঞ্চারি,
এসেছিলে বিষ্ণুচক্র মর্মন্তুদ,–ক্লৈব্যের সংহারী।
ভেঙেছিলে বাঙালির সর্বনাশী সুষুপ্তির ঘোর,
ভেঙেছিলে ধূলিশ্লিষ্ট শঙ্কিতের শৃঙ্খলের ডোর,
ভেঙেছিলে বিলাসের সুরাভান্ড তীব্র দর্পে,- বৈরাগের রাগে,
দাঁড়ালে সন্ন্যাসী যবে প্রাচীমঞ্চে-পৃথী-পুরোভাগে।
নবীন শাক্যের বেশে, কটাক্ষেতে কাম্য পরিহরি
ভাসিয়া চলিলে তুমি ভারতের ভাব-গঙ্গোত্তরী
আর্ত অর্স্পশ্যের তরে, পৃথিবীর পঞ্চমার লাগি;
বাদলের মন্দ্র সম মন্ত্র তব দিকে দিকে তুলিলে বৈরাগী।
এনেছিলে সঙ্গে করি অবিশ্রাম প্লাবনের দুন্দুভিনিনাদ,
শান্তি-প্রিয় মুমূর্ষুর শ্মশানেতে এনেছিলে আহব-সংবাদ,
গান্ডীবের টঙ্কারেতে মুহুর্মুহু বলেছিলে,- ‘আছি, আমি আছি!
কল্পশেষে ভারতের কুরুক্ষেত্রে আসিয়াছি নব সব্যসাচী।’
ছিলে তুমি দধীচির অস্থিময় বাসবের দম্ভেলির সম,
অলঙ্ঘ্য, অজেয়, ওগো লোকোত্তর, পুরুষোত্তম।
ছিলে তুমি রূদ্রের ডম্বরুরূপে, বৈষ্ণবের গুপীযন্ত্র মাঝে,
অহিংসার তপোবনে তুমি ছিলে চক্রবর্তী ক্ষত্রিয়ের সাজে,-
অক্ষয় কবচধারী শালপ্রাংশু রক্ষকের বেশে।
ফেরুকুল-সঙ্কুলিত উঞ্ছবৃত্তি ভিক্ষুকের দেশে
ছিলে তুমি সিংহশিশু, যোজনান্ত বিহরি একাকী
স্তব্ধ শিলাসন্ধিতলে ঘন ঘন গর্জনের প্রতিধ্বনি মাখি।
ছিলে তুমি নীরবতা-নিষ্পেষিত নির্জীবের নিদ্রিত শিয়রে
উন্মত্ত ঝটিকা সম, বহ্নিমান বিপ্লবের ঘোরে;
শক্তিশেল অপঘাতে দেশবক্ষে রোমাঞ্চিত বেদনার ধ্বনি
ঘুচাতে আসিয়াছিলে মৃত্যুঞ্জয়ী বিশল্যকরণী।
ছিলে তুমি ভারতের অমাময় স্পন্দহীন বিহ্বল শ্মশানে
শব-সাধকের বেশে,-সঞ্জীবনী অমৃত সন্ধানে।
রণনে রঞ্জনে তব হে বাউল, মন্ত্রমুগ্ধ ভারত, ভারতী;
কলাবিৎ সম হায় তুমি শুধু দগ্ধ হলে দেশ-অধিপতি।
বিধিবশে দূরাগত বন্ধু আজ, ভেঙে গেছে বসুধা-নির্মোক,
অন্ধকার দিবাভাগে বাজে তাই কাজরীর শ্লোকে।
মল্লারে কাঁদিছে আজ বিমানের বৃন্তহারা মেঘছত্রীদল,
গিরিতটে, ভূমিগর্ভ ছায়াচ্ছন্ন-উচ্ছ্বাসউচ্ছল।
যৌবনের জলরঙ্গ এসেছিল ঘনস্বনে দরিয়ার দেশে,
তৃষ্ণাপাংশু অধরেতে এসেছিল ভোগবতী ধারার আশ্লেষে।
অর্চনার হোমকুন্ডে হবি সম প্রাণবিন্দু বারংবার ঢালি,
বামদেবতার পদে অকাতরে দিয়ে গেল মেধ্য হিয়া ডালি।
গৌরকানি শঙ্করের অম্বিকার বেদীতলে একা
চুপে চুপে রেখে এল পূঞ্জীভূত রক্তস্রোত-রেখা।
সিন্ধু
- জীবনানন্দ দাশ---ঝরা পালক
বুকে তব সুর-পরী বিরহ-বিধুর
গেয়ে যায়, হে জলধি, মায়ার মুকুর!
কোন্ দূর আকাশের ময়ুর-নীলিমা
তোমারে উতলা করে! বালুচর সীমা
উলঙ্ঘি তুলিছ তাই শিরোপা তোমার,-
উচ্ছৃঙ্খল অট্টহাসি,-তরঙ্গের বাঁকা তলোয়ার!
গলে মৃগতৃষ্ণাবিষ, মারীর আগল
তোমার সুরার স্পর্শে আশেক-পাগল!
উদ্যত উর্মির বুকে অরূপের ছবি
নিত্যকাল বহিছ হে মরমিয়া কবি
হে দুন্দুভি দুর্জয়ের, দুরন্ত, আগধ।
পেয়েছি শক্তির তৃপ্তি, বিজয়ের স্বাদ
তোমার উলঙ্গনীল তরঙ্গের গানে!
কালে কালে দেশে দেশে মানুষ-সন্তানে
তুমি শিখায়েছ বন্দু দুর্মদ-দুরাশা!
আমাদের বুকে তুমি জাগালে পিপাসা
দুশ্চর তটের লাগি-সুদূরের তরে।
রহস্যের মায়াসৌধ বক্ষের উপরে
ধরেছ দুস্তর কাল;- তুচ্ছ অভিলাষ,
দুদিনের আশা, শানি, আকাঙক্ষা, উল্লাস,
পলকের দৈন্য-জ্বালা-জয়-পরাজয়,
ত্রাস- ব্যথা হাসি-অশ্রু-তপস্যা সঞ্চয়,-
পিনাকশিখায় তব হ’ল ছারখার।
ইচ্ছার বাড়বকুন্ডে, উগ্র পিপাসার
ধূ ধূ ধূ ধূ বেদীতটে আপনারে দিতেছ আহুতি।
মোর ক্ষুধা-দেবতারে তুমি কর স্তুতি!
নিত্য নব বাসনার হলাহলে রাঙি
‘পারীয়া’র প্রাণ লয়ে আছি মোরা জাগি
বসুধার বাঞ্ছাকূপে, উঞ্ছের অঙ্গনে!
নিমেষের খেদ-হর্ষ-বিষাদের সনে
বীভৎস খঞ্জের মতো করি মাতামাতি!
চুরমার হয়ে যায় বেলোয়ারি বাতি!
ক্ষুরধার আকাঙ্খার অগ্নি দিয়া চিতা
গড়ি তবু বারবার-বারবার ধুতুরার তিতা
নিঃস্ব নীল ওষ্ঠ তুলি নিতেছি চুমিয়া!
মোর বক্ষকপোতের কপোতিনী প্রিয়া
কোথা কবে উড়ে গেছে,-পড়ে আছে আহা
নষ্ট নীড়,- ঝরা পাতা,- পূবালির হাহা!
কাঁদে বুকে মরা নদী,- শীতের কুয়াশা!
ওহে সিন্ধু, আসিয়াছি আমি সর্বনাশা
ভুখারি ভিখারি একা, আসন্ন-বিকাশ!
-চাহি না পলার মালা, শুক্তির কলস,
মুক্তাতোরণের তট মীনকুমারীর,
চাহি না নিতল নীড় বারুণীরাণীর।
মোর ক্ষুধা উগ্র আরো, অলঙ্ঘ্য অপার!
একদিন কুকুরের মতো হাহাকার
তুলেছিনু ফোঁটা ফোঁটা রুধিরের লাগি!
একদিন মুখখানা উঠেছিল রাঙি
ক্লেদবসাপিন্ড চুমি রিক্ত বাসনার!
মোরে ঘিরে কেঁদেছিল কুহেলি আঁধার,-
শ্মশানফেরুর পাল,- শিশিরের নিশা,
আলেয়ার ভিজা মাঠে ভুলেছিনু দিশা।
আমার হৃদয়পীঠে মোর ভগবান
বেদনার পিরামিড পাহাড়প্রমাণ
গেঁথে গেছে গরলের পাত্র চুমুকিয়া;
রুদ্র তরবার তব উঠুক নাচিয়া
উচ্ছিষ্টের কলেজায়, অশিব-স্বপনে,
হে জলধি, শব্দভেদী উগ্র আস্ফালনে!
-পূজাথালা হাতে ল’য়ে আসিয়াছে কত পান্থ, কত পথবালা
সহর্ষে সমুদ্রতীরে; বুকে যার বিষ-মাখা শায়কের জ্বালা
সে শুধু এসেছে বন্ধু চুপে চুপে একা
অন্ধকারে একবার দুজনার দেখা!
বৈশাখের বেলাতটে সমুদ্রের স্বর,-
অনন্ত, অভঙ্গ, উষ্ণ, আনন্দসুন্দর!
তারপর, দূরপথে অভিযান বাহি
চলে যাব জীবনের জয়গান গাহি।
কবি
- জীবনানন্দ দাশ---ঝরা পালক
ভ্রমরীর মতো চুপে সৃজনের ছায়াধূপে ঘুরে মরে মন
আমি নিদালির আঁখি, নেশাখোর চোখের স্বপন!
নিরালায় সুর সাধি,- বাঁধি মোর মানসীর বেণী,
মানুষ দেখেনি মোরে কোনোদিন,- আমারে চেনেনি!
কোনো ভিড় কোনোদিন দাঁড়ায়নি মোর চারিপাশে,-
শুধায়নি কেহ কভু-‘আসে কি রে,- সে কি আসে-আসে!’
আসেনি সে ভরাহাটে-খয়াঘাটে-পৃথিবীর পসরায় মাঝে,
পাটনী দেখেনি তারে কোনোদিন,মাঝি তারে ডাকেনিকো সাঁঝে!
পারাপার করেনি সে মণিরত্ন-বেসাতির সিন্ধুর সীমানা,-
চেনা চেনা মুখ সবি,-সে যে সুদূর-অজানা!
করবীকুঁড়ির পানে চোখ তার সারাদিন চেয়ে আছে চুপে,
রূপ-সাগরের মাঝে কোন্ দূর গোধূলির সে যে আছে ডুবে!
সে যেন ঘাসের বুকে, ঝিলমিল শিশিরের জলে;
খুঁজে তারে পাওয়া যাবে এলোমেলো বেদিয়ার দলে,
বাবলার ফুলে ফুলে ওড়ে তার প্রজাপতি-পাখা,
ননীর আঙুলে তার কেঁপে ওঠে কচি নোনাশাখা!
হেমন্তের হিম মাঠে, আকাশের আবছায়া ফুঁড়ে
বকবধূটির মতো কুয়াশায় শাদা ডানা যায় তার উড়ে!
হয়তো শুনেছ তারে,-তার সুর,- দুপুর- আকাশে
ঝরাপাতা-ভরা মরা দরিয়ার পাশে
বেজেছে ঘুঘুর মুখে,- জল-ডাহুকীর বুকে পউষনিশায়
হলুদ পাতার ভিড়ে শিরশিরে পূবালি হাওয়ায়!
হয়তো দেখেছ তারে ভুতুড়ে দীপের চোখে মাঝরাতে দেয়ালের’পরে
নিভে- যাওয়া প্রদীপের ধূসর ধোঁয়ায় তার সুর যেন ঝরে!
শুক্লা একাদশী রাতে বিধবার বিছানায় যেই জ্যোৎস্না ভাসে
তারি বুকে চুপে চুপে কবি আসে,- সুর তার আসে।
উস্খুস্ এলোচুলে ভ’রে আছে কিশোরীর নগ্ন মুখখানি,-
তারি পাশে সুর ভাসে,- অলখিতে উড়ে যায় কবির উড়ানি!
বালুঘড়িটির বুকে ঝিরিঝিরি ঝিরিঝিরি গান যবে বাজে
রাতবিরেতের মাঠে হাঁটে সে যে আলসে,- অকাজে!
ঘুম-কুমারীর মুখে চুমো খায় যখন আকাশ
যখন ঘুমায়ে থাকে টুনটুনি,- মধুমাছি,-ঘাস,
হাওয়ার কাতর শ্বাস থেমে যায় আমলকী ঝাড়ে,
বাঁকা চাঁদ ডুবে যায় বাদলের মেঘের আঁধারে,
তেঁতুলের শাখে-শাখে বাদুড়ের কালো ডানা ভাসে,
মনের হরিণী তার ঘুরে মরে হাহাকারে বনের বাতাসে!
জোনাকির মতো সে যে দূরে দূরে যায় উড়ে উড়ে-
আপনার মুখ দেখে ফেরে সে যে নদীর মুকুরে !
জ্ব’লে ওঠে আলোয়ার মতো তার লাল আঁখিখানি।
আঁধারে ভাসায় খেয়া সে কোন্ পাষাণী!
জানে না তো কী যে চায়,- কবে হায় কী গেছে হারায়ে।
চোখ বুজে খোঁজে একা,-হাতড়ায় আঙুল বাড়ায়ে
কারে আহা।-কাঁদে হা হা পুরের বাতাস,
শ্মশানশবের বুকে জাগে এক পিপাসার শ্বাস!
তারি লাগি মুখ তোলে কোন মৃতা,-হিম চিতা জ্বেলে দেয় শিখা,
তার মাঝে যায় দহি বিরহীর ছায়া-পুত্তলিকা!
ডাকিয়া কহিল মোরে রাজার দুলাল
- জীবনানন্দ দাশ---ঝরা পালক
ডাকিয়া কহিল মোরে রাজার দুলাল,-
ডালিম ফুলের মতো ঠোঁট যার রাঙা,- আপেলের মতো লাল যার গাল,
চুল যার শাঙনের মেঘ,- আর আঁখি গোধূলির মতো গোলাপী রঙিন,
আমি দেখিয়াছি তারে ঘুমপথে,-স্বপ্নে-কত দিন!
মোর জানালার পাশে তারে দেখিয়াছি রাতের দুপুরে-
তখন শুকনবধূ যেতেছিল শ্মশানের পানে উড়ে উড়ে!
মেঘের বুরুজ ভেঙে অস্তচাঁদ দিয়েছিল উঁকি,
সে কোন্ বালিকা একা অন্তঃপুরে এল অধোমুখী!
পাথারের পারে মোর প্রাসাদের আঙিনার’ পরে
দাঁড়াল সে,- বাসররাত্রির বধূ,-মোর তরে, যেন মোর তরে!
তখন নিভিয়া গেছে মণিদীপ,-চাঁদ শুধু খেলে লুকোচুরি,-
ঘুমের শিয়রে শুধু ফুটিতেছে-ঝরিতেছে ফুলঝুরি,- স্বপনের কুঁড়ি!
অলস আঢুল হাওয়া জানালায় থেকে থেকে ফুঁপায় উদাসী!
কাতর নয়ন কার হাহাকারে চাঁদিনীতে জাগে গো উপাসী!
কিঙ্খাব -গালিচাখাটে রাজবধূ-ঝিয়ারীর বেশে
কভু সে দেয় নি দেখা,- মোর তোরণের তলে দাঁড়াল সে এসে!
দাঁড়াল সে হেঁটমুখে,- চোখ তার ভ’রে গেছে নীল অশ্রুজলে!
মীনকুমারীর মতো কোন দূর সিন্ধুর অতলে
ঘুরেছে সে মোর লাগি!-উড়েছে সে অসীমের সীমা!
অশ্রুর অঙ্গারে তার নিটোল ননীর গলা,- নরম লালিমা
জ্বলে গেছে,-নগ্ন হাত,- নাই শাখা,- হারায়েছে রুলি,
এলোমেলো কালো চুলে খ’সে গেছে খোঁপা তার,- বেণী গেছে খুলি!
সাপিনীর মতো বাঁকা আঙুলে ফুটেছে তার কঙ্কালের রূপ,
ভেঙেছে নাকের ডাঁশা,-হিম স্তন,- হিম রোমকূপ!
আমি দেখিয়াছি তারে, ক্ষুধিত প্রেতের মতো চুমিয়াছি আমি
তারই পেয়ালায় হায়!- পৃথিবীর উষা ছেড়ে আসিয়াছি নামি
কান্তারে;- ঘুমের ভিড়ে বাঁধিয়াছি দেউলিয়া বাউলের ঘর,
আমি দেখিয়াছি ছায়া, শুনিয়াছি একাকিনী কুহকীর স্বর!
বুকে মোর, কোলে মোর- কঙ্কালের কাঁকালের চুমা!
-গঙ্গার তরঙ্গ কানে গায়,- ঘুমা,- ঘুমা!
ডাকিয়া কহিল মোর রাজার দুলাল-
ডালিম ফুলের মতো ঠোঁট যার,- রাঙা আপেলের মতো লাল যার গাল,
চুল যার শাঙনের মেঘ, আর আঁখি গোধূলির মতো গোলাপী রঙিন;
আমি দেখিয়াছি তারে ঘুমপথে,- স্বপ্নে-কত দিন!
ছায়া-প্রিয়া
- জীবনানন্দ দাশ---ঝরা পালক
দুপুররাতে ও কার আওয়াজ!
গান কে গাহে,- গান না!
কপোত-বধূ ঘুমিয়ে আছে
নিঝুম ঝিঁঝির বুকের কাছে;
অস্তচাঁদের আলোর তলে
এ কার তবে কান্না!
গান কে গাহে,- গান না!
শার্শি ঘরের উঠছে বেজে,
উঠছে কেঁপে পর্দা!
বাতাস আজি ঘুমিয়ে আছে
জল-ডাহুরের বুকের কাছে;
এ কোন্ বাঁশি শার্শি বাজায়
এ কোন হাওয়া ফর্দা
দেয় কাঁপিয়ে পর্দা!
নূপুর কাহার বাজল রে ঐ!
কাঁকন কাহার কাঁদল!
পুরের বধূ ঘুমিয়ে আছে
দুধের শিশুর বুকের কাছে;
ঘরে আমার ছায়া-প্রিয়া
মায়ার মিলন ফাঁদল!
কাঁকন যে তার কাঁদল!
খসখসাল শাড়ি কাহার!
উস্খুসাল চুল গো!
পুরের বধূ ঘুমিয়ে আছে
দুধের শিশুর বুকের কাছে:
জুল্পি কাহার উঠল দুলে!
-দুলল কাহার দুল গো!
উস্খুসাল চুল গো!
আজকে রাতে কে ঐ এল
কালের সাগর সাতরি !
জীবন-ভোরের সঙ্গিনী সেই,-
মাঠে ঘাটে আজকে সে নেই !
কোন তিয়াশায় এল রে হায়
মরণপারের যাত্রী !
-কালের সাগর সাতরি !
কাঁদছে পাখি পউষনিশির
তেপান্তরের বক্ষে!
ওর বিধবা বুকের মাঝে
যেন গো কার কাঁদন বাজে!
ঘুম নাহি আজ চাঁদের চোখে,
নিদ্ নাহি মোর চক্ষে!
তেপান্তরের বক্ষে!
এল আমার ছায়া-প্রিয়া,
কিশোরবেলার সই গো!
পুরের বধূ ঘুমিয়ে আছে
দুধের শিশুর বুকের কাছে;
মনের মধু-মনোরমা,-
কই গো সে মোর- কই গো!
কিশোরবেলার সই গো!
ও কার আওয়াজ হাওয়ায় বাজে!
গান কে গাহে, গান না!
কপোত-বধূ ঘুমিয়ে আছে
বনের ছায়ায়,-মাঠের কাছে;
অস্তচাঁদের আলোর তলে
এ কার তবে কান্না!
গান কে গাহে,-গান না!
অস্তচাঁদে
- জীবনানন্দ দাশ---ঝরা পালক
ভালোবাসিয়াছি আমি অস্তচাঁদ, -ক্লান্ত শেষপ্রহরের শশী!
-অঘোর ঘুমের ঘোরে ঢলে কালো নদী,-ঢেউয়ের কলসী,
নিঝঝুম বিছানার’ পরে
মেঘ-বৌ’র খোঁপাখসা জ্যোৎস্নাফুল চুপে চুপে ঝরে,-
চেয়ে থাকি চোখ তুলে -যেন মোর পলাতকা প্রিয়া
মেঘের ঘোমটা তুলে প্রেত-চাঁদে সচকিতে ওঠে শিহরিয়া!
সে যেন দেখেছে মোরে জন্মে জন্মে ফিরে ফিরে ফিরে
মাঠে ঘাটে একা একা, -বুনোহাঁস-জোনাকির ভিড়ে!
দুশ্চর দেউলে কোন্-কোন্ যক্ষ-প্রাসাদের তটে,
দূর উর-ব্যাবিলোন-মিশরের মরুভূ-সঙ্কটে,
কোথা পিরামিডতলে,- ঈসিসের বেদিকার মূলে,
কেউটের মতো নীলা যেইখানে ফণা তুলে উঠিয়াছে ফুলে,
কোন্ মন-ভুলানিয়া পথচাওয়া দুলালীর সনে
আমারে দেখেছে জ্যোৎস্না,-চোর চোখে-অলস নয়নে!
আমারে দেখেছে সে যে আসীরীয় সম্রাটের বেশে
প্রাসাদ-অলিন্দে যবে মহিমায় দাঁড়ায়েছি এসে,-
হাতে তার হাত, পায়ে হাতিয়ার রাখি
কুমারীর পানে আমি তুলিয়াছি আনন্দের আরক্তিম আঁখি!
ভোরগেলাসের সুরা,-তহুরা,- করেছি মোরা চুপে চুপে পান,
চকোরজুড়ির মতো কুহরিয়া গাহিয়াছি চাঁদিনীর গান!
পেয়ালায়-পায়েলায় সেই নিশি হয় নি উতলা,
নীল নিচোলের কোলে নাচে নাই আকাশের তলা!
নটীরা ঘুমায়েছিল পুরে পুরে, ঘুমের রাজবধূ,-
চুরি করে পিয়েছিনু ক্রীতদাসী বালিকার যৌবনের মধু!
সম্রাজ্ঞীর নির্দয় আঁখির দর্প বিদ্রূপ ভুলিয়া
কৃষ্ণাতিথি-চাঁদিনীর তলে আমি ষোড়শীর উরু পরশিয়া
লভেছিনু উল্লাস,-উতরোল!-আজ পড়ে মনে
সাধ-বিষাদের খেদ কত জন্মজন্মান্তের,- রাতের নির্জনে!
আমি ছিনু ‘ত্রুবেদুর’ কোন্ দূর ‘প্রভেন্স’-প্রান্তরে!
-দেউলিয়া পায়দল্,-অগোচর মনচোর-মানিনীর তরে
সারেঙের সুর মোর এমনি উদাস রাত্রে উঠিত ঝঙ্কারি!
আঙুরতলায় ঘেরা ঘুমঘোর ঘরখানা ছাড়ি
ঘুঘুর পাখনা মেলি মোর পানে আসিল পিয়ারা;
মেঘের ময়ূরপাখে জেগেছিল এলোমেলো তারা!
-‘অলিভ’ পাতার ফাঁকে চুনচোখে চেয়েছিল চাঁদ,
মিলননিশার শেষে-বৃশ্চিক,- গোক্ষুরাফণা,- বিষের বিস্বাদ!
স্পেইনের ‘সিয়েরা’য় ছিনু আমি দস্যু-অশ্বারোহী-
নির্মম-কৃতান্ত-কাল,-তবু কী যে কাতর- বিরহী!
কোন্ রাজনন্দিনীর ঠোঁটে আমি এঁকেছিনু বর্বর চুম্বন!
অন্দরে পশিয়াছিনু অবেলার ঝড়ের মতন!
তখন রতনশেজে গিয়েছিল নিভে মধুরাতি,
নীল জানালার পাশে-ভাঙা হাটে-চাঁদের বেসাতি।
চুপে চুপে মুখে কার পড়েছিনু ঝুঁকে!
ব্যাধের মতন আমি টেনেছিনু বুকে
কোন্ ভীরু কপোতীর উড়ু উড়ু ডানা!
-কালো মেঘে কেঁদেছিল অস্তচাঁদ-আলোর মোহানা!
বাংলার মাঠে ঘাটে ফিরেছিনু বেণু হাতে একা,
গঙ্গার তীরে কবে কার সাথে হয়েছিল দেখা!
‘ফুলটি ফুটিলে চাঁদিনী উঠিলে’ এমনই রূপালি রাতে
কদমতলায় দাঁড়াতাম গিয়ে বাঁশের বাঁশিটি হাতে!
অপরাজিতার ঝাড়ে- নদীপারে কিশোরী লুকায়ে বুঝি!-
মদনমোহন নয়ন আমার পেয়েছিল তারে খুঁজি!
তারই লাগি বেঁধেছিনু বাঁকা চুলে ময়ূরপাখার চূড়া,
তাহারই লাগিয়া শুঁড়ি সেজেছিনু-ঢেলে দিয়েছিনু সুরা!
তাহারই নধর অধর নিঙাড়ি উথলিল বুকে মধু,
জোনাকির সাথে ভেসে শেষরাতে দাঁড়াতাম দোরে বঁধু!
মনে পড়ে কি তা!-চাঁদ জানে যাহা,- জানে যা কৃষ্ণাতিথির শশী,
বুকের আগুনে খুন চড়ে,-মুখ চুন হ’য়ে যায় একেলা বসি!
আলেয়া
- জীবনানন্দ দাশ---ঝরা পালক
প্রান্তরের পারে তব তিমিরের খেয়া
নীরবে যেতেছে দুলে নিদালি আলেয়া!
-হেথা, গৃহ-বাতায়নে নিভে গেছে প্রদীপের শিখা,
ঘোমটায় আঁখি ঘেরি রাত্রি-কুমারিকা
চুপে চুপে চলিতেছে বনপথ ধরি!
আকাশের বুকে বুকে কাহাদের মেঘের গাগরী
ডুবে যায় ধীরে ধীরে আঁধার- সাগরে!
ঢুলু-ঢুলু তারকার নয়নের’ পরে
নিশি নেমে আসে গাঢ়,-স্বপন-সঙ্কুল!
শেহালায় ঢাকা শ্যাম বালুকার কূল
বনমরালীর সাথে ঘুমায়েছে কবে!
বেণুবনশাখে কোন্ পেঁচকের রবে
চমকিছে নিরালা যামিনী!
পাতাল-নিলয় ছাড়ি কে নাগ-কামিনী
আঁকাবাঁকা গিরিপথে চলিয়াছে চিত্রা অভিসারিকার প্রায়!
শ্মশান-শয্যায়
নেভ-নেভ কোন্ চিতা-স্ফুলিঙ্গেরে ঘিরে
ক্ষুধিত আঁধার আসি জমিতেছে ধীরে!
নিদ্রার দেউলমূলে চোখ দুটি মুদে
স্বপ্নের বুদ্বুদে
বিলসিছে যবে ক্লান্ত ঘুমন্তের দল-
হে অনল,-উন্মুখ, চঞ্চল
উন্নমিত আঁখিদুটি মেলি
সন্তরি চলিছ তুমি রাত্রির কুহেলি
কোন্ দূর কামনার পানে!
ঝলমল দিবা অবসান
বধির আঁধারে
কান্তারের দ্বারে
এ কি তব মৌন নিবেদন!
-দিকভ্রান্ত,-দরদী,-উন্মন!
পল্লীপসারিণী যবে পণ্যরত্ন হেঁকে গেছে চ’লে
তোমার পিঙ্গল আঁখি ওঠে নি তো জ্ব’লে
আকাঙ্কার উলঙ্গ উল্লাসে!
-জনতায়,-নগরীর তোরণের পাশে,
অন্তঃপুরিকার বুকে,- মণিসৌধ-সোপানের তীরে,
মরকত-ইন্দ্রনীল-অয়স্কান্ত- খনির তিমিরে
যাও নি তো কভু তুমি পাথেয়- সন্ধানে!
ভাঙা হাটে,-ভিজা মাঠে,-মরণের পানে শীত প্রেতপুরে
একা একা মরিতেছ ঘুরে!
না জানি কি পিপাসার ক্ষোভে!
আমাদের ব্যর্থতায়,- আমাদের সকাতর কামনায় লোভে
মাগিতে আসনি তুমি নিমেষের ঠাঁই!
-অন্ধকার জলাভূমি,- কঙ্কালের ছাই,
পল্লীকান্তারের ছায়া,-তেপান্তর পথের বিস্ময়
নিশীথের দীর্ঘশ্বাসময়
করিয়াছে বিমনা তোমারে!
রাত্রি-পারাবারে
ফিরিতেছ বারম্বার একাকী বিচরি!
হেমন্তের হিম পথ ধরি,
পউষ আকাশতলে দহি দহি দহি
- ছুটিতেছে বিহ্বল বিরহী
কত শত যুগজন্ম বহি!
কারে কবে বেসেছিলে ভালো
হে ফকির,- আলেয়ার আলো!
কোন্ দূরে অস্তমিত যৌবনের স্মৃতি বিমথিয়া
চিত্তে তব জাগিতেছে কবেকার প্রিয়া!
সে কোন্ রাত্রির হিমে হ’য়ে গেছে হারা!
নিয়েছে ভুলায়ে তারে মায়াবী ও নিশিমরু,-
আঁধার- সাহারা!
আজো তব লোহিত- কপোলে
চুম্বন-শোণিমা তার উঠিতেছে জ্ব’লে
অনল-ব্যথায়!
-চ’লে যায়,-মিলনের লগ্ন চ’লে যায়!
দিকে দিকে ধূমাবাহু যায় তব ছুটি
অন্ধকারে লুটি লুটি লুটি!
ছলাময় আকাশের নিচে
লক্ষ প্রেতবধূদের পিছে
ছুটিয়া চলিছে তব প্রেম-পিপাসার
অগ্নি অভিসার!
বহ্নি-ফেনা নিঙাড়িয়া পাত্র ভরি ভরি,
অনন্ত অঙ্গার দিয়া হৃদয়ের পান্ডুলিপি গড়ি,
উষার বাতাস ভুলি,- পলাতকা রাত্রির পিছনে
যুগ যুগ ছুটিতেছ কার অন্বেষণে।
কদিন খুঁজেছিনু যারে-
- জীবনানন্দ দাশ---ঝরা পালক
একদিন খুঁজেছিনু যারে
বকের পাখার ভিড়ে বাদলের গোধূলি-আঁধারে,
মালতীলতার বনে,- কদমের তলে,
নিঝুম ঘুমের ঘাটে,-কেয়াফুল,- শেফালীর দলে!
-যাহারে খুঁজিয়াছিনু মাঠে মাঠে শরতের ভোরে
হেমন্তের হিম ঘাসে যাহারে খুঁজিয়াছিনু ঝরোঝরো
কামিনীর ব্যথার শিয়রে
যার লাগি ছুটে গেছি নির্দয় মসুদ চীনা তাতারের দলে,
আর্ত কোলাহলে
তুলিয়াছি দিকে দিকে বাধা বিঘ্ন ভয়,-
আজ মনে হয়
পৃথিবীর সাঁজদীপে তার হাতে কোনোদিন জ্বলে নাই শিখা!
-শুধু শেষ-নিশীথের ছায়া-কুহেলিকা,
শুধু মেরু-আকাশের নীহারিকা, তারা
দিয়ে যায় যেন সেই পলাতকা চকিতার সাড়া!
মাঠে ঘাটে কিশোরীর কাঁকনের রাগিণীতে তার সুর
শোনে নাই কেউ,
গাগরীর কোলে তার উথলিয়া ওঠে নাই আমাদের
গাঙিনীর ঢেউ!
নামে নাই সাবধানী পাড়াগাঁর বাঁকাপথের চুপে চুপে
ঘোমটার ঘুমটুকু চুমি!
মনে হয় শুধু আমি,- আর শুধু তুমি
আর ঐ আকাশের পউষ-নীরবতা
রাত্রির নির্জনযাত্রী তারকার কানে- কানে কত কাল
কহিয়াছি আধো- আধো কথা!
-আজ বুঝি ভুলে গেছে প্রিয়া!
পাতাঝরা আঁধারের মুসাফের-হিয়া
একদিন ছিল তব গোধূলির সহচর,- ভুলে গেছ তুমি!
এ মাটির ছলনার সুরাপাত্র অনিবার চুমি
আজ মোর বুকে বাজে শুধু খেদ,- শুধু অবসাদ!
মহুয়ার,- ধুতুরার স্বাদ
জীবনের পেয়ালায় ফোঁটা ফোঁটা ধরি
দুরন্ত শোণিতে মোর বারবার নিয়েছি যে ভরি!
মসজেদ-সরাই-শরাব
ফুরায় না তৃষা মোর,- জুড়ায় না কলেজার তাপ!
দিকে দিকে ভাদরের ভিজা মাঠ,-আলেয়ার শিখা!
পদে পদে নাচে ফণা,-
পথে পথে কালো যবণিকা!
কাতর ক্রন্দন,-
কামনার কবর-বন্ধন!
কাফনের অভিযান,-অঙ্গার- সমাধি!
মৃত্যুর সুমেরু সিন্ধু অন্ধকারে বারবার উঠিতেছে কাঁদি!
মর্মর্ কেঁদে ওঠে ঝরাপাতা-ভরা ভোররাতের পবন,-
আধো আঁধারের দেশে
বারবার আসে ভেসে
কার সুর!-
কোন্ সুদুরের তরে হৃদয়ের প্রেতপুরে ডাকিনীর মতো মোর
কেঁদে মরে মন!
কদিন খুঁজেছিনু যারে-
- জীবনানন্দ দাশ---ঝরা পালক
একদিন খুঁজেছিনু যারে
বকের পাখার ভিড়ে বাদলের গোধূলি-আঁধারে,
মালতীলতার বনে,- কদমের তলে,
নিঝুম ঘুমের ঘাটে,-কেয়াফুল,- শেফালীর দলে!
-যাহারে খুঁজিয়াছিনু মাঠে মাঠে শরতের ভোরে
হেমন্তের হিম ঘাসে যাহারে খুঁজিয়াছিনু ঝরোঝরো
কামিনীর ব্যথার শিয়রে
যার লাগি ছুটে গেছি নির্দয় মসুদ চীনা তাতারের দলে,
আর্ত কোলাহলে
তুলিয়াছি দিকে দিকে বাধা বিঘ্ন ভয়,-
আজ মনে হয়
পৃথিবীর সাঁজদীপে তার হাতে কোনোদিন জ্বলে নাই শিখা!
-শুধু শেষ-নিশীথের ছায়া-কুহেলিকা,
শুধু মেরু-আকাশের নীহারিকা, তারা
দিয়ে যায় যেন সেই পলাতকা চকিতার সাড়া!
মাঠে ঘাটে কিশোরীর কাঁকনের রাগিণীতে তার সুর
শোনে নাই কেউ,
গাগরীর কোলে তার উথলিয়া ওঠে নাই আমাদের
গাঙিনীর ঢেউ!
নামে নাই সাবধানী পাড়াগাঁর বাঁকাপথের চুপে চুপে
ঘোমটার ঘুমটুকু চুমি!
মনে হয় শুধু আমি,- আর শুধু তুমি
আর ঐ আকাশের পউষ-নীরবতা
রাত্রির নির্জনযাত্রী তারকার কানে- কানে কত কাল
কহিয়াছি আধো- আধো কথা!
-আজ বুঝি ভুলে গেছে প্রিয়া!
পাতাঝরা আঁধারের মুসাফের-হিয়া
একদিন ছিল তব গোধূলির সহচর,- ভুলে গেছ তুমি!
এ মাটির ছলনার সুরাপাত্র অনিবার চুমি
আজ মোর বুকে বাজে শুধু খেদ,- শুধু অবসাদ!
মহুয়ার,- ধুতুরার স্বাদ
জীবনের পেয়ালায় ফোঁটা ফোঁটা ধরি
দুরন্ত শোণিতে মোর বারবার নিয়েছি যে ভরি!
মসজেদ-সরাই-শরাব
ফুরায় না তৃষা মোর,- জুড়ায় না কলেজার তাপ!
দিকে দিকে ভাদরের ভিজা মাঠ,-আলেয়ার শিখা!
পদে পদে নাচে ফণা,-
পথে পথে কালো যবণিকা!
কাতর ক্রন্দন,-
কামনার কবর-বন্ধন!
কাফনের অভিযান,-অঙ্গার- সমাধি!
মৃত্যুর সুমেরু সিন্ধু অন্ধকারে বারবার উঠিতেছে কাঁদি!
মর্মর্ কেঁদে ওঠে ঝরাপাতা-ভরা ভোররাতের পবন,-
আধো আঁধারের দেশে
বারবার আসে ভেসে
কার সুর!-
কোন্ সুদুরের তরে হৃদয়ের প্রেতপুরে ডাকিনীর মতো মোর
কেঁদে মরে মন!
চলছি উধাও
- জীবনানন্দ দাশ---ঝরা পালক
চলছি উধাও, বল্গাহারা,- ঝড়ের বেগে ছুটি !
শিকল কে সে বাঁধছে পায়ে!
কোন্ সে ডাকাত ধরছে চেপে টুটি!
-আঁধার আলোর সাগর-শেষে
প্রেতের মতো আসছে ভেসে!
আমার দেহের ছায়ার মতো, জড়িয়ে আছে মনের সনে,
যেদিন আমি জেগেছিলাম, -সে-ও জেগেছে আমার মনে!
আমার মনের অন্ধকারে
ত্রিশূলমূলে,-দেউলদ্বারে
কাটিয়েছে সে দুরন্ত কাল ব্যর্থ- পূজার পুষ্প ঢেলে!
স্বপন তাহার সফল হবে আমায় পেলে, -আমায় পেলে!
রাত্রি-দিবার জোয়ার স্রোতে
নোঙর-ছেঁড়া হৃদয় হ’তে
জেগেছে সে হালের নাবিক,-
চোখের ধাঁধায়,- ঝড়ের ঝাঁঝে,-
মনের মাঝে,- মানের মাঝে !
আমার চুমোর অন্বেষণে
প্রিয়ার মতো আমার মনে
অঙ্কহারা কাল ঘুরেছে কাতর দুটি নয়ন তুলে,
চোখের পাতা ভিজিয়ে তাহার আমার অশ্রু-পাথার-কূলে!
ভিজে মাঠের অন্ধকারে কেঁদেছে মোর সাথে
হাতটি রেখে হাতে!
দেখিনি তার মুখখানি তো,-
পাইনি তারে টের,
জানিনি হায় আমার বুকে আশেক,-অসীমের
জেগে আছে জনম-ভোরের সূতিকাগার থেকে!
কত নতুন শরাবশালায় নাবনু একে একে!
সরাইখানার দিলপিয়ালায় মাতি
কাটিয়ে দিলাম কত খুশির রাতি!
জীবন-বীণার তারে তারে আগুন-ছড়ি টানি
গুলজারিয়া এল গেল কত গানের রানি,-
নাশপাতি-গাল গালে রাখি কানে কানে করলে কানাকানি
শরাব-নেশায় রাঙিয়ে দিল আঁখি!
-ফুলের ফাগে বেহুঁশ হলি নাকি!
হঠাৎ কখন স্বপন-ফানুস কোথায় গেল উড়ে!
-জীবন মরু- মরীচিকার পিছে ঘুরে ঘুরে
ঘায়েল হ’য়ে ফিরল আমার বুকের ক্যারাভেন,-
আকাশ-চরা শ্যেন!
মরু-ঝড়ের হাহাকারে মৃগতৃষার লাগি
প্রাণ যে তাহার রইল তবু জাগি
ইবলিসেরি সঙ্গে তাহার লড়াই হ’ল শুরু!
দরাজ বুকে দিল্ যে উড়ু- উড়ু !
-ধূসর ধূ ধূ দিগন্তরে হারিয়ে- যাওয়া নার্গিসেরি শোভা
থরে থরে উঠল ফুটে রঙিন-মনোলোভা!
অলীক আশার,-দূর-দুরশার দুয়ার ভাঙার তরে
যৌবন মোর উঠল নেচে রক্তমুঠি,-ঝড়ের ঝুঁটির’ পরে!
পিছে ফেলে টিকে থাকার ফাটক- কারাগারে,
ভেঙে শিকল,- ধ্বসিয়ে ফাঁড়ির দ্বার
চলল সে যে ছুটে!
শৃঙ্খল কে বাধল তাহার পায়ে,-
চুলের ঝুঁটি ধরল কে তার মুঠে!
বর্শা আমার উঠল ক্ষেপে খুনে,
হুমকি আমার উঠল বুকে রুখে!
দুশমন কে পথের সুমুখে।
-কোথায় কে বা!
এ কোন মায়া!
মোহ এমন কার!
বুকে আমার বাঘের মতো গর্জাল হুঙ্কার!
মনের মাঝের পিছুডাকা উঠল বুঝি হেঁকে,-
সে কোন সুদূর তারার আলোরে থেকে
মাথার পরের খাঁ খাঁ মেঘের পাথারপুরী ছেড়ে
নেমে এল রাত্রিদিবার যাত্রা-পথে কে রে!
কী তৃষা তার!...
কী নিবেদন!...
মাগছে কিসের ভিখ্!...
উদ্যত পথিক
হঠাৎ কেন যাচ্ছে থেমে,-
আজকে হঠাৎ থামতে কেন হয়!
-এই বিজয়ী কার কাছে আজ মাগছে পরাজয়!
পথ- আলেয়ার খেয়ায় ধোঁয়ায় ধ্রুবতারার মতন কাহার আঁখি
আজকে নিল ডাকি
হালভাঙা এই ভুতের জাহাজটারে!
মড়ার খুলি,-পাহাড়-প্রমাণ হাড়ে
বুকে তাহার জ’মে গেছে কত শ্মশান-বোঝা!
আক্রোশে হা ছুটছিল সে একরোখা,- এক সোজা
চুম্বকেরি ধ্বংসগিরির পানে,
নোঙর-হারা মাস্তুলেরি টানে!
প্রেতের দলে ঘুরেছিল প্রেমের আসন পাতি,-
জানে কি সে বুকের মাঝে আছে তাহার সাথী!
জানে কি সে ভোরের আকাশ,- লক্ষ তারার আলো
তাহার মনের দূয়ার-পথেই নিরিখ হারালো!
জানেনি সে তোহার ঠোঁটের একটি চুমোর তরে
কোন্ দিওয়ানার সারেং কাঁদে
নয়নে নীর ঝরে!
কপোত-ব্যথা ফাটে রে- কার অপার গগন ভেদি!
তাহার বুকের সীমার মাঝেই কাঁদছে কয়েদি
কোন্ সে অসীম আসি!
লক্ষ সাকীর প্রিয় তাহার বুকের পাশাপাশি
প্রেমের খবর পুছে
কবের থেকে কাঁদতে আছে,-
‘পেয়ালা দে রে মুঝে!’
সাগর বলাকা
- জীবনানন্দ দাশ---ঝরা পালক
ওরে কিশোর, বেঘোর ঘুমের বেহুঁশ হাওয়া ঠেলে
পাতলা পাখা দিলি রে তোর দূর-দুরাশায় মেলে!
ফেনার বৌয়ের নোন্তা মৌয়ের- মদের গেলাস লুটে,
ভোর-সাগরের শরাবখানায়–মুসল্লাতে জুটে
হিমের ঘুণে বেড়াস খুনের আগুনদানা জ্বেলে!
ওরে কিশোর, অস্তরাগের মেঘের চুমায় রেঙে
নীল নহরের স্বপন দেখে চৈতি চাঁদে জেগে
ছুটছ তুমি চ্ছলচ্ছল জলের কোলাহলের সাথে কই!
উছলে ওঠে বুকে তোমার আল্তো ফেনা-সই!
ঢেউয়ের ছিটায় মিঠা আঙুল যাচ্ছে ঠোঁটে লেগে!
রে মুসাফের,- পাতাল-প্রেতপুরের মরীচিকা
সাগর-জলের তলে বুঝি জ্বালিয়ে দেছে শিখা!
তাই কি গেলে ভেঙে হেথায় বালিয়াড়ির বাড়ি!
দিচ্ছ যাযাবরের মতো সাগর-মরু-পাড়ি,-
ডাইনে তোমার ডাইনীমায়া- পিছের আকাশ ফিকা!
বাসা তোমার সাতসাগরের ঘূর্ণী হাওয়ার বুকে!
ফুটছে ভাষা কেউটে- ঢেউয়ের ফেনার ফণা ঠুকে!
প্রায়ণ তোমার প্রবালদ্বীপে, পলার মালা গলে
বরুণ-রানি ফিরছে যেথা,-মুক্তা-প্রদীপ জ্বলে!
যেথায় মৌন মীনকুমারীর শঙ্খ ওঠে ফুঁকে।
যেই খানে মূক মায়াবিনীর কাঁকন শুধু বাজে
সাঁজ সকালে,- ঢেউয়ের তালে, মাঝসাগরের মাঝে!
যায় না জাহাজ যেথায়,- নাবিক, পায় না নাগাল যার,
লুঘ উদাস পাখায় ভেসে আঁখির তলে তার
ঘুরছে অবুঝ সে কোন সবুজ স্বপন-খোঁজার কাজে!
ওরে কিশোর, -দূর-সোহাগী ঘর- বিরাগী সুখ!
-টুকটুকে কোন্ মেঘের পারে ফুটফুটে কার মুখ
ডাকছে তোদের ডাগর কাঁচা চোখের কাছে তার!
-শাদা শকুন-পাখায় যে তাই তুলছে হাহাকার
ফাঁপা ঢেউয়ের চাপা কাঁদন,-ফাঁপর- ফাটা বুক!
বনের চাতক–মনের চাতক
- জীবনানন্দ দাশ---ঝরা পালক
বনের চাতক বাঁধল বাসা মেঘের কিনারায়,-
মনের চাতক হারিয়ে গেল দূরের দুরাশায়!
ফুঁপিয়ে ওঠে কাতর আকাশ সেই হতাশার ক্ষোভে,-
সে কোন্ বোঁটের ফুলের ঠোঁটের মিঠা মদের লোভে
বনের চাতক-মনের চাতক কাঁদছে অবেলায়!
পুবের হাওয়ায় হাপর জ্বলে, আগুনদানা ফাটে!
কোন্ ডাকিনীর বুকের চিতায় পচিম আকাশ টাটে!
বাদল-বৌয়ের চুমার মৌয়ের সোয়াদ চেয়ে চেয়ে
বনের চাতক-মনের চাতক চলছে আকাশ বেয়ে,
ঘাটের ভরা কলসি ও-কার কাঁদছে মাঠে মাঠে!
ওরে চাতক,-বনের চাতক, আয় রে নেমে ধীরে
নিঝুম ছায়া-বৌরা যেথা ঘুমায় দীঘি ঘিরে,
‘দে জল!’ ব’লে ফোঁপাস কেন? মাটির কোলে জল
খবর-খোঁজা সোজা চোখের সোহাগে ছল্ছল্ !
মজিস নে রে আকাশ-মরুর মরীচিকার তীরে!
বনের চাতক,- হতাশ উদাস পাখায় দিয়ে পাড়ি
কোথায় গেলি ঘরের কোণের কানাকানি ছাড়ি?
ননীর কলস আছে রে তার কাঁচা বুকের কাছে,
আতার ক্ষীরের মতো সোহাগ সেথায় ঘিরে আছে!
আয় রে ফিরে দানোয়-পাওয়া, আয় রে তাড়াতাড়ি।
বনের চাতক,,-মনের চাতক আসে না আর ফিরে,
কপোত-ব্যথা বাজায় মেঘের শকুনপাখা ঘিরে!
সে-কোন্ ছুঁড়ির চুড়ি আকাশ-শুঁড়িখানায় বাজে!
চিনিমাখা ছায়ায় ঢাকা চুনীর ঠোঁটের মাঝে
লুকিয়ে আছে সে-কোন্ মধু মৌমাছিদের ভিড়ে!
নাবিক
- জীবনানন্দ দাশ---ঝরা পালক
কবে তব হৃদয়ের নদী
বরি নিল অসম্বৃত সুনীল জলধি!
সাগর-শকুন্ত-সম উল্লাসের রবে
দূর সিন্ধু-ঝটিকার নভে
বাজিয়া উঠিল তব দুরন্ত যৌবন!
-পৃথ্বীর বেলায় বসি কেঁদে মরে আমাদের শৃঙ্খলিত মন!
কারাগার-মর্মরের তলে
নিরাশ্রয় বন্দিদের খেদ-কোলাহলে
ভ’রে যায় বসুধার আহত আকাশ!
অবনত শিরে মোরা ফিরিতেছি ঘৃণ্য বিধিবিধানের দাস!
-সহস্রের অঙ্গুলিতর্জন
নিত্য সহিতেছি মোরা,-বারিধির বিপ্লব-গর্জন
বরিয়া লয়েছ তুমি,- তারে তুমি বাসিয়াছ ভালো;
তোমার পঞ্জরতলে টগ্বগ্ করে খুন-দুরন্ত, ঝাঁঝালো!-
তাই তুমি পদাঘাতে ভেঙে গেলে অচেতন বসুধার দ্বার,
অবগুণ্ঠিতার
হিমকৃষ্ণ অঙ্গুলির কঙ্কাল-পরশ
পরিহরি গেলে তুমি,-মৃত্তিকার মদ্যহীন রস
তুহিন নির্বিষ নিঃস্ব পানপাত্রখানা
চকিতে চূর্ণিয়া গেলে,-সীমাহারা আকাশের নীল শামিয়ানা
বাড়ব-আরক্ত স্ফীত বারিধির তট,
তরঙ্গের তুঙ্গ গিরি, দুর্গম সঙ্কট
তোমারে ডাকিয়া নিল মায়াবীর রাঙা মুখ তুলি!
নিমেষে ফেলিয়া গেলে ধরণীর শূন্য ভিক্ষাঝুলি!
প্রিয়ার পাণ্ডুর আঁখি অশ্রু-কুহেলিকা-মাখা গেলে তুমি ভুলি!
ভুলে গেলে ভীরু হৃদয়ের ভিক্ষা, আতুরের লজ্জা অবসাদ,-
অগাধের সাধ
তোমারে সাজায়ে দেছে ঘরছাড়া ক্ষ্যাপা সিন্দবাদ!
মণিময় তোরণের তীরে
মৃত্তিকায় প্রমোদ-মন্দিরে
নৃত্য-গীত-হাসি-অশ্রু-উৎসবের ফাঁদে
হে দুরন্ত দুর্নিবার,-প্রাণ তব কাঁদে!
ছেড়ে গেলে মর্মন্তুদ মর্মর বেষ্টন,
সমুদ্রের যৌবন-গর্জন
তোমারে ক্ষ্যাপায়ে দেছে, ওহে বীর- শের!
টাইফুন্-ডঙ্কার হর্ষে ভুলে গেছ অতীত-আখের
হে জলধি পাখি!
পক্ষে তব নাচিতেছে লক্ষ্যহারা দামিনী-বৈশাখী!
ললাটে জ্বলিছে তব উদয়াস্ত আকাশের রত্নচূড় ময়ূখের টিপ,
কোন্ দূর দারুচিনি লবঙ্গের সুবাসিত দ্বীপ
করিতেছে বিভ্রান্ত তোমারে!
বিচিত্র বিহঙ্গ কোন্ মণিময় তোরণের দ্বারে
সহর্ষ নয়ন মেলি হেরিয়াছ কবে!
কোথা দূরে মায়াবনে পরীদল মেতেছে উৎসবে,-
স্তম্ভিত নয়নে
নীল বাতায়নে
তাকায়েছ তুমি!
অতিদূর আকাশের সন্ধ্যারাগ-প্রতিবিম্বে প্রস্ফুটিত সমুদ্রের
আচম্বিত ইন্দ্রজাল চুমি
সাজিয়াছ বিচিত্র মায়াবী!
সৃজনের জাদুঘর-রহস্যের চাবি
আনিয়াছ কবে উন্মোচিয়া
হে জল-বেদিয়া!
অলক্ষ্য বন্দর পানে ছুটিতেছ তুমি নিশিদিন
সিন্ধু- বেদুঈন!
নাহি গৃহ- নাহি পান্থশালা-
লক্ষ লক্ষ ঊর্মি-নাগবালা
তোমারে নিতেছে ডেকে রহস্য-পাতালে-
বারুণী যেথায় তার মণিদীপ জ্বালে!
প্রবাল-পালঙ্ক-পাশে মীননারী ঢুলায় চামর!
সেই দুরাশার মোহে ভুলে গেছ পিছু-ডাকা স্বর,
ভুলেছ নোঙর!
কোন্ দূর কুহকের কূল
লক্ষ্য করি ছুটিতেছে নাবিকের হৃদয়-মাস্তুল
কে বা তাহা জানে!
অচিন আকাশ তারে কোন্ কথা কয় কানে কানে!
বেদিয়া
- জীবনানন্দ দাশ---ঝরা পালক
চুলিচালা সব ফেলেছে সে ভেঙে, পিঞ্জরহারা পাখি!
পিছুডাকে কভু আসে না ফিরিয়া, কে তারে আনিবে ডাকি?
উদাস উধাও হাওয়ার মতন চকিতে যায় সে উড়ে,
গলাটি তাহার সেধেছে অবাধ নদী-ঝর্ণার সুরে;
নয় সে বান্দা রংমহলের, মোতিমহলের বাঁদী,
ঝোড়ো হাওয়া সে যে, গৃহ-প্রাঙ্গণে কে তারে রাখিবে বাঁধি!
কোন্ সুদূরের বেনামী পথের নিশানা নেছে সে চিনে,
ব্যর্থ ব্যথিত প্রান্তর তার চরণ-চিহ্ন বিনে!
যুগযুগান্ত কত কান্তার তার পানে আছে চেয়ে,
কবে সে আসিবে ঊষর ধূসর বালুকা-পথটি বেয়ে
তারই প্রতীক্ষা মেগে ব’সে আছে ব্যাকুল বিজন মরু!
দিকে দিকে কত নদী-নির্ঝর কত গিরি-চূড়া-তরু
ঐ বাঞ্ছিত বন্ধুর তরে আসন রেখেছে পেতে
কালো- মৃত্তিকা ঝরা- কুসুমের বন্দনা-মালা গেঁথে
ছড়ায়ে পড়িছে দিকদিগন্তে ক্ষ্যাপা পথিকের লাগি!
বাবলা বনের মৃদুল গন্ধে বন্ধুর দেখা মাগি
লুটায়ে রয়েছে কোথা সীমান্তে শরৎ- উষার শ্বাস!
ঘুঘু-হরিয়াল-ডাহুক-শালিখ-গাঙচিল-বুনোহাঁস
নিবিড় কাননে তটিনীর কূলে ডেকে যায় ফিরে ফিরে
বহু পুরাতন পরিচিত সেই সঙ্গী আসিল কি রে!
তারই লাগি ভায় ইন্দ্রধনুক নিবিড় মেঘের কূলে,
তারই লাগি আসে জোনাকি নামিয়া গিরিকন্দর মূলে।
ঝিনুক-নুড়ির অঞ্জলি ল’য়ে কলরব ক’রে ছুটে
নাচিয়া আসিছে অগাধ সিন্ধু তারই দুটি করপুটে।
তারই লাগি কোথা বালুপথে দেখা দেয় হীরকের কোণা,
তাহারই লাগিয়া উজানী নদীর ঢেউয়ে ভেসে আসে সোনা!
চকিতে পরশপাথর কুড়ায়ে বালকের মতো হেসে
ছুড়ে ফেলে দেয় উদাসী বেদিয়া কোন্ সে নিরুদ্দেশে!
যত্ন করিয়া পালক কুড়ায়, কানে গোঁজে বনফুল,
চাহে না রতন-মণিমঞ্জুষা হীরে-মাণিকের দুল,
-তার চেয়ে ভালো অমল উষার কনক-রোদের সিঁথি,
তার চেয়ে ভালো আলো-ঝলমল শীতল শিশির-বীথি,
তার চেয়ে ভালো সুদূর গিরির গোধূলি-রঙিন জটা,
তার চেয়ে ভালো বেদিয়া বালার ক্ষিপ্র হাসির ছটা!
কী ভাষা বলে সে, কী বাণী জানায়, কিসের বারতা বহে!
মনে হয় যেন তারই তরে তবু দুটি কান পেতে রহে
আকাশ-বাতাস-আলোক-আঁধার মৌন স্বপ্নভরে,
মনে হয় যেন নিখিল বিশ্ব কোল পেতে তার তরে!
জীবন-মরণ দুয়ারে আমার
- জীবনানন্দ দাশ---ঝরা পালক
সরাইখানার গোলমাল আসে কানে,
ঘরের শার্শি বাজে তাহাদের গানে,
পর্দা যে উড়ে যায়
তাদের হাসির ঝড়ের আঘাতে হায়!
-মদের পাত্র গিয়েছে কবে যে ভেঙে!
আজো মন ওঠে রেঙে
দিলদারদের দরাজ গলায় রবে,
সরায়ের উৎসবে!
কোন্ কিশোরীর চুড়ির মতন হায়
পেয়ালা তাদের থেকে থেকে বেজে যায়
বেহুঁশ হাওয়ার বুকে!
সারা জনমের শুষে-নেওয়া খুন নেচে ওঠে মোর মুখে!
পান্ডুর দু’টি ঠোঁটে
ডালিমফুলের রক্তিম আভা চকিতে আবার ফোটে!
মনের ফলকে জ্বলিছে তাদের হাসি ভরা লাল গাল,
ভুলে গেছে তারা এই জীবনের যত কিছু জঞ্জাল!
আখেরের ভয় ভুলে
দিলওয়ার প্রাণ খুলে
জীবন-রবাবে টানিছে ক্ষিপ্ত ছড়ি!
অদূরে আকাশে মধুমালতীর পাপড়ি পড়িছে ঝরি,-
নিভিছে দিনের আলো,
-জীবন- মরণ দুয়ারে আমার, কারে যে বাসিব ভালো
একা একা তাই ভাবিয়া মরিছে মন!
পূর্ণ হয় নি পিপাসী প্রাণের একটি আকিঞ্চন,
খুলেনি একটি দল,-
যৌবন- শতদলে মোর হায় ফোটে নাই পরিমল!
উৎসবলোভী অলি
আসে নি হেথায়,-
কীটের আঘাতে শুকায়ে গিয়েছে কবে কামনার কলি!
-সারাটি জীবন বাতায়নখানি খুলে
তাকায়ে দেখেছি নগরী-মরুতে ক্যারাভেন্ যায় দুলে
আশা-নিরাশার বালু-পারাবার বেয়ে,
সুদূর মরুদ্যানের পানেতে চেয়ে!
সুখ-দুঃখের দোদুল ঢেউঢের তালে
নেচেছে তাহারা,- মায়াবীর জাদুজালে
মাতিয়া গিয়েছে খেয়ালী মেজাজ খুলি,
মৃগতৃষ্ণার মদের নেশায় ভুলি!
মস্তানা সেজে ভেঙে গেছ ঘর-দোর,
লোহার শিকের আড়ালে জীবন লুটায়ে কেঁদেছে মোর!
কারার ধুলায় লুন্ঠিত হ’য়ে বান্দার মতো হায়
কেঁদেছে বুকের বেদুঈন মোর দুরাশার পিপাসায়!
জীবনপথের তাতার দস্যুগুলি
হুল্লোড় তুলি উড়ায়ে গিয়েছে ধূলি
মোর গবাক্ষে কবে!
কন্ঠ-বাজের আওয়াজ তাদের বেজেছে স্তব্ধ নভে!
আতুর নিদ্রা চকিতে গিয়েছে ভেঙে,
সারাটি নিশীথ খুন- রোশনাই প্রদীপে মনটি রেঙে
একাকী রয়েছি বসি,
নিরালা গগনে কখন নিভেছে শশী
পাই নি যে তাহা টের!
-দূর দিগন্তে- চ’লে গেছে কোথা খুশরোজী মুসাফের!
কোন্ সুদূরের তুরাণী প্রিয়ার তরে,
বুকের ডাকাত আজিও আমার জিঞ্জিরে কেঁদে মরে!
দীর্ঘ দিবস ব’য়ে গেছে যারা হাসি-অশ্রুর বোঝা
চাঁদের আলোকে ভেঙেছে তাদের ‘রোজা’;
আমার গগনে ‘ঈদরাত’ কভু দেয় নি হায় দেখা,
পরানে কখনও জাগে নি ‘রোজা’র ঠেকা!
কী যে মিঠা এই সুখের দুখের ফেনিল জীবনখানা!
এই যে নিষেধ, এই যে বিধান,-আইন-কানুন, এই যে শাসন মানা,
ঘরদোর- ভাঙা তুমুল প্রলয়ধ্বনি
নিত্য গগনে এই যে উঠিছে রণি
যুবানবীনের নটনর্তন তালে,
ভাঙনের গান এই যে বাজিছে দেশে দেশে কালে কালে,
এই যে তৃষ্ণা-দৈন্য-দুরাশা-জয়-সংগ্রাম-ভুল
সফেন সুরার ঝাঁঝের মতন ক’রে দেয় মজ্গুল
দিওয়ানা প্রাণের নেশা!
ভগবান,- ভগবান,- তুমি যুগ যুগ থেকে ধরেছ শুঁড়ির পেশা!
-লাখো জীবনের শূণ্য পেয়ালা ভরি দিয়া বারবার
জীবন-পান্থশালার দেয়ালে তুলিতেছে ঝঙ্কার,-
মাতালের চিৎকার !
অনাদি কালের থেকে;
মরণশিয়রে মাথা পেতে তার দস্তুর যাই দেখে!
হেরিলাম দূরে বালুকার পরে রূপার তাবিজ প্রায়
জীবনের নদী কলরোলে ব’য়ে যায়!
কোটি শুঁড় দিয়ে দুখের মরুভূ নিতেছে তাহারে শুষে,
ছলা-মরীচিকা জ্বলিতেছে তার প্রাণের খেয়াল-খুশে!
মরণ-সাহারা আসি
নিতে চায় তারে গ্রাসি।-
তবু সে হয় না হারা
ব্যথার রুধির-ধারা
জীবন-মদের পাত্র জুড়িয়া তার
যুগ যুগ ধরি অপরূপ সুরা গড়িছে মশালাদার!
মরীচিকার পিছে
- জীবনানন্দ দাশ---ঝরা পালক
ধূম্র তপ্ত আঁধির কুয়াশা তরবারি দিয়ে চিরে
সুন্দর দূর মরীচিকাতটে ছলনামায়ার তীরে
ছুটে যায় দুটি আঁখি!
-কত দূর হায় বাকি!
উধাও অশ্ব বগ্লাবিহীন অগাধ মরুভূ ঘিরে,
পথে পথে তার বাধা জ’মে যায়,-তবু সে আসে না ফিরে!
দূরে,-দূরে,- আরো দূরে,-আরো দূরে,
অসীম মরুর পারাবার-পারে আকাশ- সীমানা জুড়ে
ভাসিয়াছে মরুতৃষা!
-হিয়া হারায়েছে দিশা!
কে যেন ডাকিছে আকুল অলস উদাস বাঁশির সুরে
কোন্ দিগন্তে নির্জন কোন্ মৌন মায়াবী-পুরে!
কোন্-এক সুনীল দরিয়া সেথায় উত্থলিছে অনিবার!
-কান পেতে একা শুনেছে সে তার অপরূপ ঝঙ্কার,
ছোটে অঞ্জলি পেতে,
তৃষার নেশায় মেতে,
উষর ধূসর মরুর মাঝারে এমন খেয়াল কার!
খুলিয়া দিয়াছে মাতাল ঝর্ণা না জানি কে দিলদার!
কে যেন রেখেছে সবুজ ঘাসের কোমল গালিচা পাতি!
যত খুন যত খারাবীর ঘোরে পরান আছিল মাতি,
নিমেষে গিয়েছে ভেঙে
স্বপন-আবেশে রেঙে
আঁখি দু’টি তার জৌলস্- রাঙা হ’য়ে গেছে রাতারাতি!
কোন্ যেন এক জিন-সর্দার সেজেছে তাহার সাথী।
কোন্ যেন পরী চেয়ে আছে দু’টি চঞ্চল চোখ তুলে!
পাগলা হাওয়ায় অনিবার তার ওড়না যেতেছে দুলে!
গেঁথে গোলাপের মালা
তাকায়ে রয়েছে বালা,
বিলায়ে দিয়েছে রাঙা নার্গিস্ কালো পশমিনা চুলে!
বসেছে বালিকা খর্জুরছায়ে নীল দরিয়ার কূলে।
ছুটিছে ক্লিষ্ট ক্লান্ত অশ্ব কশাঘাত- জর্জর,
চারিদিকে তার বালুর পাথার,-মরুর হাওয়ার ঝড়;
নাহি শ্রান্তির লেশ,
সুদুর নিরুদ্দেশ-
অসীম কুহক পাতিয়া রেখেছে তাহার বুকের’পর!
পথের তালাসে পাগল সোয়ার হারায়ে ফেলেছে ঘর!
আঁখির পলকে পাহাড়ের পারে কোথা সে ছুটিয়া যায়!
চকিত আকাশ পায় না তাহার নাগাল খুঁজিয়া হায়!
ঝড়ের বাতাস মিছে
ছুটছে তাহার পিছে!
মরুভূর প্রেত চকমিয়া তার চক্ষের পানে চায়,-
সুরার তালাসে চুমুক দিল কে গরলের পেয়ালায়!
কিশোরের প্রতি
- জীবনানন্দ দাশ---ঝরা পালক
যৌবনের সুরাপাত্র গরল-মদির
ঢালোনি অধরে তব, ধরা-মোহিনীর
উর্ধ্বফণা মায়া-ভুজঙ্গিনী
আসে নি তোমার কাম্য উরসের পথটুকু চিনি,
চুমিয়া চুমিয়া তব হৃদয়ের মধু
বিষবহ্নি ঢালেনিকো বাসনার বধূ
অন্তরের পানপাত্রে তব;
অম্লান আনন্দ তব, আপ্লুত উৎসব,
অশ্রুহীন হাসি,
কামনার পিছে ঘুরে সাজোনি উদাসী।
ধবল কাশের দলে, আশ্বিনের গগনের তলে
তোর তরে রে কিশোর, মৃগতৃষ্ণা কভু নাহি জ্বলে!
নয়নে ফোটে না তব মিথ্যা মরুদ্যান।
অপরূপ রূপ-পরীস্থান
দিগন্তের আগে
তোমার নির্মেঘ-চক্ষে কভু নাহি জাগে!
আকাশকুসুবীথি দিয়া
মাল্য তুমি আনো না রচিয়া,
উধাও হও না তুমি আলেয়ার পিছে
ছলাময় গগনের নিচে!
-রূপ-পিপাসায় জ্বলি মৃত্যুর পাথারে
স্পন্দহীন প্রেতপুরদ্বারে
করোনিকো করাঘাত তুমি
সুধার সন্ধানে লক্ষ বিষপাত্র চুমি
সাজোনিকো নীলকন্ঠ ব্যাকুল বাউল!
অধরে নাহিকো তৃষ্ণা, চক্ষে নাহি ভুল,
রক্তে তব অলক্ত যে পরে নাই আজও রানী,
রুধির নিঙাড়ি তব আজও দেবী মাগে নাই রক্তিম চন্দন।
কারাগার নাহি তব, নাহিকো বন্ধন;
দীঘল পতাকা, বর্শা তন্দ্রাহারা প্রহরীর লও নি তুলিয়া,
-সুকুমার কিশোরের হিয়া!
-জীবনসৈকতে তব দুলে যায় লীলায়িত লঘুনৃত্য নদী,
বক্ষে তব নাচে নিকো যৌবনের দুরন্ত জলধি;
শূল-তোলা শম্ভূর মতন
আস্ফালিয়া উঠে নাই মন
মিথ্যা বাধা-বিধানের ধ্বংসের উল্লাসে!
তোমার আকাশে
দ্বাদশ সূর্যের বহ্নি ওঠেনিকো জ্বলি
কক্ষচ্যুত উল্কাসম পড়েনিকো স্খলি,
কুজ্ঝটিকা-আবর্তের মাঝে
অনির্বাণ স্ফুলিঙ্গের সাজে!
সব বিঘ্ন সকল আগল
ভাঙিয়া জাগোনি তুমি স্পন্দন-পাগল
অনাগত স্বপ্নের সন্ধানে
দুরন্ত দুরাশা তুমি জাগাও নি প্রাণে।
নিঃস্ব দুটি অঞ্জলির আকিঞ্চন মাগি
সাজোনিকো দিকভোলা দিওয়ানা বৈরাগী!
পথে পথে ভিক্ষা মেগে কাম্য কল্পতরু
বাজাওনি শ্মশান-ডমরু!
জ্যোৎস্নাময়ী নিশি তব, জীবনের অমানিশা ঘোর
চক্ষে তব জাগেনি কিশোর!
আঁধারের নির্বিকল্প রূপ,
স্পন্দহীন বেদনার কূপ
রুদ্ধ তব বুকে;
তোমার সম্মুখে
ধরিত্রী জাগিছে ফুল্ল-সুন্দরীর বেশে,
নিত্য বেলাশেষে
যেই পুষ্প ঝরে,
যে বিরহ জাগে চরাচরে,
গোধূলির অবসানে শ্লোকম্লান সাঁঝে,
তাহার বেদনা তব বক্ষে নাহি বাজে,
আকাঙ্খার অগ্নি দিয়া জ্বালো নাই চিতা,
ব্যথার সংহিতা
গাহ নাই তুমি!
দরিয়ার তীর ছাড়ি দেখ নাই দাব-মরুভূমি
জ্বলন্ত নিষ্ঠুর!
নগরীর ক্ষুব্ধ বক্ষে জাগে যেই মৃত্যুপ্রেতপুর,
ডাকিনীর রুক্ষ অট্টহাসি
ছন্দ তার মর্মে তব ওঠে না প্রকাশি!
সভ্যতার বীভৎস ভৈরবী
মলিন করে নি তব মানসের ছবি,
ফেনিল করেনি তব নভোনীল, প্রভাতের আলো,
এ উদভ্রান্ত যুবকের বক্ষে তার রশ্মি আজ ঢালো, বন্ধু, ঢালো!
নব নবীনের লাগি
- জীবনানন্দ দাশ---ঝরা পালক
-নব নবীনের লাগি
প্রদীপ ধরিয়া আঁধারের বুকে আমার রয়েছি জাগি!
ব্যর্থ পঙ্গু খর্ব প্রাণের বিকল শাসন ভেঙে,
নব আকাঙক্ষা আশার স্বপনে হৃদয় মোদের রেঙে,
দেবতার দ্বারে নবীন বিধান-নতুন ভিক্ষা মেগে
দাঁড়ায়েছি মোরা তরুণ প্রাণের অরুণের অনুরাগী!
ঝড়ের বাতাস চাই।
-চারিদিক ঘিরে শীতের কুহেলি, -শ্মশানপথের ছাই,
ছড়ায়ে রয়েছে পাহাড় প্রমাণ মৃতের অস্থি খুলি,
কে সাজাবে ঘর দেউলের’পর কঙ্কাল তুলি তুলি?
সূর্য চন্দ্র নিভায়ে কে নেবে জরার চোখের ঠুলি!
-মরার ধরায় জ্যান্ত কখনও মাগিতে যাবে কি ঠাঁই!
ঘুমায়ে কে আছে ঘরে!
মৃতুশিশু-বুকে কল্যাণী পুরকামিনী কি আজ মরে!
কে আছে বসিয়া হতাশ উদাস অলস অন্যমনা?
দোদুল আকাশে দুলিয়া উঠিছে রাঙা অশনির ফণা,
বাজে বাদলের রঙ্গমল্লী. ঝঞ্ঝার ঝঞ্ঝনা!
ফিরিছে বালক-ঘর পলাতক ঝরা পালকের ঝড়ে!
আমরা অশ্বরোহী!-
যাযাবর যুবা, বন্দিনীদের ব্যথা মোরা বুকে বহি,
মানবের মাঝে যে দেবতা আছে আমরা তাহারে বরি ,
মোদের প্রাণের পূজার দেউলে তাহার প্রতিমা গড়ি,
চুয়া-চন্দন-গন্ধ বিলায়ে আমরা ঝরিয়া পড়ি,
সুবাস ছড়াই উশীরের মতো, ধূপের মতন দহি!
গাহি মানবের জয়!
-কোটি কোটি বুকে কোটি ভগবান আঁখি মেলে জেগে রয়!
সবার প্রাণের অশ্রু-বেদনা মোদের বক্ষে লাগে,
কোটি বুকে কোটি দেউটি জ্বলিছে-কোটি কোটি শিখা জাগে,
প্রদীপ নিভায়ে মানবদেবের দেউল যাহারা ভাঙে,
আমরা তাদের শস্ত্র, শাসন, আসন করিব ক্ষয়!
-জয় মানবের জয়!
নীলিমা
- জীবনানন্দ দাশ---ঝরা পালক
রৌদ্র ঝিল্মিল,
উষার আকাশ, মধ্য নিশীথের নীল,
অপার ঐশ্বর্যবেশে দেখা তুমি দাও বারে বারে
নিঃসহায় নগরীর কারাগার-প্রাচীরের পারে!
-উদ্বেলিছে হেথা গাঢ় ধূম্রের কুণ্ডলী,
উগ্র চুল্লিবহ্নি হেথা অনিবার উঠিতেছে জ্বলি,
আরক্ত কঙ্করগুলো মরুভূর তপ্তশ্বাস মাখা,
-মরীচিকা-ঢাকা!
অগণন যাত্রিকের প্রাণ
খুঁজে মরে অনিবার,- পায় নাকো পথের সন্ধান;
চরণে জড়ায়ে গেছে শাসনের কঠিন শৃঙ্খল-
হে নীলিমা নিষ্পলক, লক্ষ বিধিবিধানের এই কারাতল
তোমার ও- মায়াদণ্ডে ভেঙেছ মায়াবী।
জনতার কোলাহলে একা ব’সে ভাবি
কোন্ দূর জাদুপুর-রহস্যের ইন্দ্রজাল মাখি
বাস্তবের রক্ততটে আসিলে একাকী!
স্ফটিক আলোকে তব বিথারিয়া নীলাম্বরখানা
মৌন স্বপ্ন-ময়ূরের ডানা!
চোখে মোর মুছে যায় ব্যাধবিদ্ধ ধরণীর রুধির-লিপিকা
জ্বলে ওঠে অন্তহারা আকাশের গৌরী দীপশিখা!
বসুধার অশ্রু-পাংশু আতপ্ত সৈকত,
ছিন্নবাস, নগ্নশির ভিক্ষুদল, নিষ্করুণ এই রাজপথ,
লক্ষ কোটি মুমূর্ষুর এই কারাগার,
এই ধূলি-ধূম্রগর্ভ বিস্তৃত আঁধার
ডুবে যায় নীলিমায়-স্বপ্নায়ত মুগ্ধ আঁখিপাতে,
-শঙ্খশুভ্র মেঘপুঞ্জে , শুক্লাকাশে, নক্ষত্রের রাতে;
ভেঙে যায় কীটপ্রায় ধরণীর বিশীর্ণ নির্মোক,
তোমার চকিত স্পর্শে, হে অতন্দ্র দূর কল্পলোক!
স্বপ্নের হাত
- জীবনানন্দ দাশ---ধূসর পান্ডুলিপি
পৃথিবীর বাধা- এই দেহের ব্যাঘাতে
হৃদয়ে বেদনা জমে;- স্বপনের হাতে
আমি তাই
আমারে তুলিয়া দিতে চাই !
যেইসব ছায়া এসে পড়ে
দিনের – রাতের ঢেউয়ে ,- তাহাদের তরে
জেগে আছে আমার জীবন ;
সব ছেড়ে আমাদের মন
ধরা দিত যদি এই স্বপনের হাতে !
পৃথিবীর রাত আর দিনের আঘাতে
বেদনা পেত না তবে কেউ আর ,-
থাকিত না হৃদয়ের জরা ,-
সবাই স্বপ্নের হাতে দিত যদি ধরা !...
আকাশ ছায়ার ঢেউয়ে ঢেকে
সারা দিন- সারা রাত্রি অপেক্ষায় থেকে ,
পৃথিবীর যত ব্যথা,- বিরোধ ,- বাস্তব
হৃদয় ভুলিয়া যায় সব !
চাহিয়াছে অন্তর যে- ভাষা ,
যেই ইচ্ছা,- যেই ভালোবাসা
খুঁজিয়াছে পৃথিবীর পারে পারে গিয়া ,-
স্বপ্নে তাহা সত্য হয়ে উঠেছে ফলিয়া !
মরমের যত তৃষ্ণা আছে ,-
তারি খোঁজে ছায়া আর স্বপ্নের কাছে
তোমরা চলিয়া আস ,-
তোমরা চলিয়া আস সব ! –
ভুলে যাও পৃথিবীর ঐ ব্যথা – ব্যাঘাত – বাস্তব!...
সকল সময়
স্বপ্ন – শুধু স্বপ্ন জন্ম লয়
যাদের অন্তরে ,-
পরস্পরে যারা হাত ধরে
নিরালা ঢেউয়ের পাশে পাশে ,-
গোধূলির অস্পষ্ট আকাশে
যাহাদের আকাঙ্ক্ষার জন্ম- মৃত্যু ,- সব,-
পৃথিবীর দিন আর রাত্রির রব
শোনে না তাহারা !
সন্ধ্যার নদীর জল,- পাথরে জলের ধারা
আয়নার মতো
জাগিয়া উঠিছে ইতস্তত
তাহাদের তরে ।
তাদের অন্তরে
স্বপ্ন,- শুধু স্বপ্ন জন্ম লয়
সকল সময় !...
পৃথিবীর দেয়ালের’পরে
আঁকাবাঁকা অসংখ্য অক্ষরে
একবার লিখিয়াছি অন্তরের কথা,-
সে সব ব্যর্থতা
আলো আর অন্ধকারে গিয়াছে মুছিয়া !
দিনের উজ্জ্বল পথ ছেড়ে দিয়ে
ধূসর স্বপ্নের দেশে গিয়া
হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষার নদী
ঢেউ তুলে তৃপ্তি পায়- ঢেউ তুলে তৃপ্তি পায় যদি ,-
তবে ওই পৃথিবীর দেয়ালের’পরে
লিখিতে যেও না তুমি অস্পষ্ট অক্ষরে
অন্তরের কথা !
আলো আর অন্ধকারে মুছে যায় সে সব ব্যর্থতা ! ...
পৃথিবীর ওই অধীরতা
থেমে যায় ,- আমাদের হৃদয়ের ব্যথা
দূরের ধুলোর পথ ছেড়ে
স্বপ্নেরে – ধ্যানেরে
কাছে ডেকে লয় !-
উজ্জ্বল আলোর দিন নিভে যায় ,
মানুষেরো আয়ু শেষ হয় !
পৃথিবীর পুরানো সে- পথ
মুছে ফেলে রেখা তার ,-
কিন্তু এই স্বপ্নের জগৎ
চিরদিন রয় !
সময়ের হাত এসে মুছে ফেলে আর সব ,-
নক্ষত্রেরো আয়ু শেষ হয় !
মৃত্যুর আগে
- জীবনানন্দ দাশ---ধূসর পান্ডুলিপি
আমরা হেঁটেছি যারা নির্জন খড়ের মাঠে পউষসন্ধ্যায়,
দেখেছি মাঠের পারে নরম নদীর নারী ছড়াতেছে ফুল
কুয়াশার ; কবেকার পাড়াগাঁর মেয়েদের মতো যেন হায়
তারা সব; আমরা দেখেছি যারা অন্ধকারে আকন্দ ধুন্দুল
জোনাকিতে ভ’রে গেছে; যে মাঠে ফসল নাই তাহার শিয়রে
চুপ দাঁড়ায়েছে চাঁদ – কোনো সাধ নাই তার ফসলের তরে;
আমরা বেসেছি যারা অন্ধকারে দীর্ঘ শীত- রাত্রিটিরে ভালো ,
খড়ের চালের’পরে শুনিয়াছি মুগ্ধরাতে ডানার সঞ্চার ;
পুরানো পেঁচার ঘ্রাণ ;- অন্ধকারে আবার সে কোথায় হারালো !
বুঝেছি শীতের রাত অপরূপ ,- মাঠে মাঠে ডানা ভাসাবার
গভীর আহ্লাদে ভরা; অশত্থের ডালে – ডালে ডাকিয়াছে বক ;
আমরা বুঝেছি যারা জীবনের এইসব নিভৃত কুহক;
আমরা দেখেছি যারা বুনোহাঁস শিকারীর গুলির আঘাত
এড়ায়ে উড়িয়া যায় দিগন্তের নম্র নীল জ্যোৎস্নার ভিতরে,
আমরা রেখেছি যারা ভালোবেসে ধানের গুচ্ছের’পরে হাত,
সন্ধ্যার কাকের মতো আকাঙ্ক্ষায় আমরা ফিরেছি যারা ঘরে;
শিশুর মুখের গন্ধ, ঘাস, রোদ , মাছরাঙা , নক্ষত্র , আকাশ
আমরা পেয়েছি যারা ঘুরে-ফিরে ইহাদের চিহ্ন বারো-মাস;
দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হয়েছে হলুদ,
হিজলের জানালায় আলো আর বুলবুলি করিয়াছে খেলা,
ইঁদুর শীতের রাতে রেশমের মতো রোমে মাখিয়াছে খুদ ,
চালের ধূসর গন্ধে তরঙ্গেরা রূপ হয়ে ঝরেছে দু’বেলা
নির্জন মাছের চোখে;- পুকুরের পাড়ে হাঁস সন্ধ্যার আঁধারে
পেয়েছে ঘুমের ঘ্রাণ – মেয়েলি হাতের স্পর্শ লয়ে গেছে তারে;
মিনারের মতো মেঘ সোনালি চিলেরে তার জানালায় ডাকে,
বেতের লতার নিচে চড়ুয়ের ডিম যেন শক্ত হয়ে আছে,
নরম জলের গন্ধ দিয়ে বার-বার তরীটিরে মাখে ,
খড়ের চালের ছায়া গাড় রাতে জ্যোৎস্নার উঠানে পড়িয়াছে ;
বাতাসে ঝিঁঝিঁর গন্ধ- বৈশাখের প্রান্তরের সবুজ বাতাসে;
নীলাভ নোনার বুকে ঘন রস গাড় আকাঙ্ক্ষায় নেমে আসে ;
আমরা দেখেছি যারা নিবিড় বটের নিচে লাল লাল ফল
প’ড়ে আছে; নির্জন মাঠের ভিড় মুখ দেখে নদীর ভিতরে ;
যত নীল আকাশেরা রয়ে গেছে খুঁজে ফেরে আরো নীল আকাশের তল;
পথে পথে দেখিয়াছি মৃদু চোখ ছায়া ফেলে পৃথিবীর’পরে ;
আমরা দেখেছি যারা শুপুরির সারি বেয়ে সন্ধ্যা আসে রোজ ,
প্রতিদিন ভোর আসে ধানের গুচ্ছের মতো সবুজ সহজ;
আমরা বুঝেছি যারা বহু দিন মাস ঋতু শেষ হলে পর
পৃথিবীর সেই কন্যা কাছে এসে অন্ধকারে নদীদের কথা
ক’য়ে গেছে ;- আমরা বুঝেছি যারা পথ ঘাট মাঠের ভিতর
আরো এক আলো আছে :দেহে তার বিকেলবেলার ধূসরতা ;
চোখের –দেখার হাত ছেড়ে দিয়ে সেই আলো হয়ে আছে স্থির :
পৃথিবীর কঙ্কাবতী ভেসে গিয়ে সেইখানে পায় ম্লান ধূপের শরীর ;
আমরা মৃত্যুর আগে কি বুঝিতে চাই আর ? জানি না কি আহা,
সব রঙ কামনার শিয়রে যে দেয়ালের মতো এসে জাগে
ধূসর মৃত্যুর মুখ ;- একদিন পৃথিবীতে স্বপ্ন ছিল – সোনা ছিল যাহা
নিরুত্তর শান্তি পায়;- যেন কোন মায়াবীর প্রয়োজনে লাগে ।
কি বুঝিতে চাই আর ? ... রৌদ্র নিভে গেলে পাখি – পাখালির ডাক
শুনিনি কি ? প্রান্তরের কুয়াশায় দেখিনি কি উড়ে গেছে কাক !
শকুন
- জীবনানন্দ দাশ---ধূসর পান্ডুলিপি
মাঠ থেকে মাঠেমাঠে – সমস্ত দুপুর ভ’রে এশিয়ার আকাশেআকাশে
শকুনেরা চরিতেছে; মানুষ দেখেছে হাট ঘাঁটি বস্তি,- নিস্তব্ধ প্রান্তর
শকুনের; যেখানে মাঠের দৃঢ় নীরবতা দাঁড়ায়েছে আকাশের পাশে
আরেক আকাশ যেন,- সেইখানে শকুনেরা একবার নামে পরস্পর
কঠিন মেঘের থেকে ;- যেন দূর আলো ছেড়ে ধূম্র ক্লান্ত দিকহস্তিগণ
প’ড়ে গেছে;- প’ড়ে গেছে পৃথিবীতে এশিয়ার ক্ষেত মাঠ প্রান্তরের’পর
এইসব ত্যক্ত পাখি কয়েক মুহূর্ত শুধু;- আবার করিছে আরোহণ
আঁধার বিশাল ডানা পাম গাছে,- পাহাড়ের শিঙে শিঙে সমুদ্রের পারে ;
একবার পৃথিবীর শোভা দেখে,- বোম্বায়ের সাগরের জাহাজ কখন
বন্দরের অন্ধকারে ভিড় করে, দেখে তাই;- একবার স্নিগ্ধ মালাবারে
উড়ে যায়;- কোন এক মিনারের বিমর্ষ কিনার ঘিরে অনেক শকুন
পৃথিবীর পাখিদের ভুলে গিয়ে চ’লে যায় যেন কোন মৃত্যুর ওপারে ;
যেন কোন বৈতরণী অথবা এ জীবনের বিচ্ছেদের বিষণ্ণ লেগুন
কেঁদে ওঠে ... চেয়ে দেখে কখন গভীর নীলে মিশে সেইসব হূন ।
পাখিরা
- জীবনানন্দ দাশ---ধূসর পান্ডুলিপি
ঘুমে চোখ চায় না জড়াতে ,-
বসন্তের রাতে
বিছানায় শুয়ে আছি;-
এখন সে কত রাত !
ওই দিকে শোনা যায় সমুদ্রের স্বর
স্কাইলাইট মাথার উপর ,
আকাশে পাখিরা কথা কয় পরস্পর ।
তারপর চ’লে যায় কোথায় আকাশে ?
তাদের ডানার ঘ্রাণ চারিদিকে ভাসে !
শরীরে এসেছে স্বাদ বসন্তের রাতে,
চোখ আর চায় না ঘুমাতে;
জানালার থেকে ওই নক্ষত্রের আলো নেমে আসে ,
সাগরের জলের বাতাসে
আমার হৃদয় সুস্থ হয় ;
সবাই ঘুমায়ে আছে সব দিকে,-
সমুদ্রের এই ধারে কাহাদের নোঙরের হয়েছে সময় ?
সাগরের ওই পারে –আরো দূর পারে
কোনো এক মেরুর পাহাড়ে
এইসব পাখি ছিল;
ব্লিজারডের তাড়া খেয়ে দলে দলে সমুদ্রের’পর
নেমেছিল তারা তারপর,-
মানুষ যেমন তার মৃত্যুর অজ্ঞানে নেমে পড়ে !
বাদামি- সোনালি- শাদা- ফুটফুট ডানার ভিতরে
রবারের বলের মতন ছোটো বুকে
তাদের জীবন ছিল,-
যেমন রয়েছে মৃত্যু লক্ষ লক্ষ মাইল ধ’রে সমুদ্রের মুখে
তেমন অতল সত্য হয়ে !
কোথাও জীবন আছে, জীবনের স্বাদ রহিয়াছে,
কোথাও নদীর জল রয়ে গেছে- সাগরের তিতা ফেনা নয়;
খেলার বলের মতো তাদের হৃদয়
এই জানিয়াছে ;-
কোথাও রয়েছে প’ড়ে শীত পিছে, আশ্বাসের কাছে
তারা আসিয়াছে।
তারপর চ’লে যায় কোন এক ক্ষেতে
তাহার প্রিয়ের সাথে আকাশের পথে যেতে যেতে
সে কি কথা কয়?
তাদের প্রথম ডিম জন্মিবার এসেছে সময় !
অনেক লবণ ঘেঁটে সমুদ্রের পাওয়া গেছে এ মাটির ঘ্রাণ ,
ভালোবাসা আর ভালোবাসার সন্তান ,
আর সেই নীড় ,
এই স্বাদ – গভীর- গভীর ।
আজ এই বসন্তের রাতে
ঘুমে চোখ চায় না জড়াতে ;
ওই দিকে শোনা যায় সমুদ্রের স্বর
স্কাইলাইট মাথার উপর ,
আকাশে পাখিরা কথা কয় পরস্পর ।
পিপাসার গান
- জীবনানন্দ দাশ---ধূসর পান্ডুলিপি
কোনো এক অন্ধকারে আমি
যখন যাইব চ’লে – বারবার আসিব কি নামি
অনেক পিপাসা লয়ে এ মাটির তীরে
তোমাদের ভিড়ে !
কে আমারে ব্যথা দেছে ,- কে বা ভালোবাসে ,-
সব ভুলে ,- শুধু মোর দেহের তালাশে
শুধু মোর স্নায়ু শিরা রক্তের তরে
এ মাটির’পরে
আসিব কি নেমে !
পথে পথে,- থেমে- থেমে- থেমে
খুঁজিব কি তারে ,-
এখানের আলোয় -আঁধারে
যেইজন বেঁধেছিল বাসা !-
মাটির শরীরে তার ছিল যে পিপাসা ,
আর যেই ব্যথা ছিল,- যেই ঠোঁট , চুল,
যেই চোখ ,- যেই হাত,- আর যে আঙুল
রক্ত আর মাংসের স্পর্শসুখভরা ,-
যেই দেহ একদিন পৃথিবীর ঘ্রাণের পসরা
পেয়েছিল ,- আর তার ধানীসুরা করেছিল পান,
একদিন শুনেছে যে জল আর ফসলের গান,
দেখেছে যে ঐ নীল আকাশের ছবি
মানুষ – নারীর মুখ ,- পুরুষ – স্ত্রীর দেহ সবি
যার হাত ছুঁয়ে আজো উষ্ণ হয়ে আছে ,-
ফিরিয়া আসিবে সে কি তাহাদের কাছে !
প্রণয়ীর মতো ভালোবেসে
খুঁজিবে কি এসে
একখানা দেহ শুধু !-
হারায়ে গিয়েছে কবে কঙ্কালে কাঁকরে
এ মাটির’পরে !
অন্ধকারে সাগরের জল
ছেনেছে আমার দেহ ,- হয়েছে শীতল
চোখ – ঠোঁট- নাসিকা- আঙ্গুল
তাহার ছয়াছে;- ভিজে গেছে চুল
শাদাশাদা ফেনাফুলে ;
কতবার দূর উপকূলে
তারাভরা আকাশের তলে
বালকের মতো এক – সমুদ্রের জলে
দেহ ধুয়ে নিয়া
জেনেছি দেহের স্বাদ ;- গেছে বুক-মুখ পরশিয়া
রাঙা রোদ ,- নারীর মতন
এ দেহ পেয়েছে যেন তাহার চুম্বন
ফসলের ক্ষেতে !
প্রথম প্রণয়ী সে যে , কারতিকের ভোরবেলা দূরে যেতেযেতে
থেমে গেছে সে আমার তরে !
চোখ দুটো ফের ঘুমে ভরে
যেন তার চুমো খেয়ে !
এদেহ,- অলস মেয়ে
পুরুষের সোহাগে অবশ !-
চুমে লয় রৌদ্রের রস
হেমন্ত বৈকালে
উড় পাখপাখালীর পালে
উঠানের ;- পেতে থাকে কান,-
শোনে ঝরা শিশিরের গান
অঘ্রাণের মাঝরাতে ;
হিম হাওয়া যেন শাদা কঙ্কালের হাতে
এ দেহেরে এসে ধরে ,-
ব্যথা দেয় ! নারীর অধরে
চুলে- চোখে – জুয়ের নিশ্বাসে
ঝুমকো- লতার মতো তার দেহ- ফাঁসে
ভরা ফসলের মতো পড়ে ছিঁড়ে
এই দেহ ,- ব্যথা পায় ফিরে!...
তবু এই শস্যক্ষেতে পিপাসার ভাষা
ফুরাবে না;- কে বা সেই চাষা,-
কাস্তে হাতে ,- কঠিন –কামুক,-
আমাদের সবটুকু ব্যথাভরা সুখ
উচ্ছেদ করিবে এসে একা ! –
কে বা সেই !- জানি না তো ,- হয় নাই দেখা
আজো তার সনে;
আজ শুধু দেহ- আর দেহের পীড়নে
সাধ মোর ;- চোখে ঠোঁটে চুলে
শুধু পীড়া ,-শুধু পীড়া !- মুকুলে মুকুলে
শুধু কীট ,- আঘাত,-দংশন ,-
চায় আজ মন !
নক্ষত্রের পানে যেতেযেতে
পথ ভুলে বারবার পৃথিবীর ক্ষেতে
জন্মিতেছি আমি এক সবুজ ফসল !-
অন্ধকারে শিশিরের জল
কানে কানে গাহিয়াছে গান,-
ঢালিয়াছে শীতল আঘ্রাণ ;
মোর দেহ ছেনে গেছে অলস-আঢুল
কুমারী আঙুল
কুয়াশার ; ঘ্রাণ আর পরশের সাধ
জাগায়েছে ;- কাস্তের মতো বাঁকা চাঁদ
ঢালিয়াছে আলো ,-
প্রণয়ীর ঠোঁটের ধারালো
চুম্বনের মতো !
রেখে গেছে ক্ষত
সবজীর সবুজ রুধিরে!
শস্যের মতো মোর এ শরীর ছিঁড়ে
বারবার হয়েছে আহত
আগুনের মতো
দুপুরের রাঙা রোদ !
আমি তবু ব্যথা দেই,-
ব্যথা পাই ফিরে!-
তবু চাই সবুজ শরীরে
এ ব্যথার সুখ !
লাল আলো ,- রৌদ্রের চুমুক,
অন্ধকার ,- কুয়াশার ছুরি
মোরে যেন কেটে লয়,- যেন গুঁড়ি গুঁড়ি
ধুলো মোরে ধীরে লয় শুষে !-
মাঠ- মাঠে – আড়ষ্ট পউষে
ফসলের গন্ধ বুকে ক’রে
বারবার পড়ি যেন ঝ’রে!
আবার পাব কি আমি ফিরে
এই দেহ !- এ মাটির নিঃসাড় শিশিরে
রক্তের তাপ ঢেলে আমি
আসিব কি নামি !
হেমন্তের রৌদ্রের মতন
ফসলের স্তন
আঙুলে নিঙাড়ি
এক ক্ষেত ছাড়ি
অন্য ক্ষেতে চলিব কি ভেসে
এ সবুজ দেশে
আর একবার! শুনিব কি গান
ঢেউদের !- জলের আঘ্রাণ
লব বুকে তুলে
আমি পথ ভুলে
আসিব কি এ পথে আবার !
ধুলো-বিছানার
কীটেদের মতো
হব কি আহত
ঘাসের আঘাতে!
বেদনার সাথে
সুখ পাব !
লতার মতন মোর চুল,
আমার আঙুল
পাপড়ির মতো ,-
হবে কি বিক্ষত
তোমার আঙুলে – চুলে !
লাগিবে কি ফুলে
ফুলের আঘাত! বারবার
আমার এ পিপাসার ধার
তোমাদের জাগাবে পিপাসা !
ক্ষুধিতের ভাষা
বুকে ক’রে ক’রে
ফলিব কি !- পড়িব কি ঝ’রে
পৃথিবীর শস্যের ক্ষেতে
আর একবার আমি-
নক্ষত্রের পানে যেতে যেতে ।
প্রেম
- জীবনানন্দ দাশ---ধূসর পান্ডুলিপি
আমরা ঘুমায়ে থাকি পৃথিবীর গহ্বরের মতো ,-
পাহাড় নদীর পারে অন্ধকারে হয়েছে আহত
একা- হরিণীর মতো আমাদের হৃদয় যখন !
জীবনের রোমাঞ্চের শেষ হলে ক্লান্তির মতন
পাণ্ডুর পাতার মতো শিশিরে শিশিরে ইতস্তত
আমরা ঘুমায়ে থাকি !- ছুটি লয়ে চ’লে যায় মন !-
পায়ের পথের মতো ঘুমন্তেরা প’ড়ে আছে কত,-
তাদের চোখের ঘুম ভেঙ্গে যাবে আবার কখন !-
জীবনের জ্বর ছেড়ে শান্ত হয়ে রয়েছে হৃদয় ,-
অনেক জাগার পর এইমতো ঘুমাইতে হয় ।
অনেক জেনেছে ব’লে আর কিছু হয় না জানিতে ;
অনেক মেনেছে ব’লে আর কিছু হয় না মানিতে;
দিন- রাত্রি- গ্রহ- তারা- পৃথিবী- আকাশ ধ’রে-ধ’রে
অনেকে উড়েছে যারা অধীর পাখির মতো ক’রে,-
পৃথিবীর বুক থেকে তাহাদের ডাকিয়া আনিতে
পুরুষ পাখির মতো ,- প্রবল হাওয়ার মতো জোরে
মৃত্যুও উড়িয়া যায় !- অসাড় হতেছে পাতা শীতে,
হৃদয়ে কুয়াশা আসে,- জীবন যেতেছে তাই ঝ’রে
পাখির মতন উড়ে পায়নি যা পৃথিবীর কোলে –
মৃত্যুর চোখের’পরে চুমো দেয় তাই পাবে ব’লে !
কারন, সাম্রাজ্য – রাজ্য- সিংহাসন – জয়-
মৃত্যুর মতন নয় ,- মৃত্যুর শান্তির মতো নয় !
কারন , অনেক অশ্রু – রক্তের মতন অশ্রু ঢেলে
আমরা রাখিতে আছি জীবনের এই আলো জ্বেলে !
তবুও নক্ষত্র নিজে নক্ষত্রের মতো জেগে রয় !-
তাহার মতন আলো হৃদয়ের অন্ধকারে পেলে
মানুষের মতো নয়,- নক্ষত্রের মতো হতে হয় !
মানুষের মতো হয়ে মানুষের মতো চোখ মেলে
মানুষের মতো পায়ে চলিতেছে যত দিন ,-তাই ,-
ক্লান্তির পরে ঘুম,- মৃত্যুর মতন শান্তি চাই ১
কারণ , যোদ্ধার মতো – আর সেনাপতির মতন
জীবন যদিও চলে ,- কোলাহল ক’রে চলে মন
যদিও সিন্ধুর মতো দল বেঁধে জীবনের সাথে ,
সবুজ বনের মতো উত্তরের বাতাসের হাতে
যদিও বীণার মতো বেজে ওঠে হৃদয়ের বন
একবার-দুইবার- জীবনের অধীর আঘাতে ,-
তবু- প্রেম- তবু তারে ছিঁড়ফেড়ে গিয়েছে কখন !
তেমন ছিঁড়িতে পারে প্রেম শুধু !- অঘ্রাণের রাতে
হাওয়া এসে যেমন পাতার বুক চ’লে গেছে ছিঁড়ে !
পাতার মতন ক’রে ছিঁড়ে গেছে যেমন পাখিরে !
তবু পাতা – তবুও পাখির মতো ব্যথা বুকে লয়ে,
বনের শাখার মতো – শাখার পাখির মতো হয়ে
হিমের হাওয়ার হাতে আকাশের নক্ষত্রের তলে
বিদীর্ণ শাখার শব্দে – অসুস্থ ডানার কোলাহলে ,
ঝড়ের হাওয়ার শেষে ক্ষীণ বাতাসের মতো বয়ে,
আগুন জ্বলিয়া গেলে অঙ্গারের মতো তবু জ্বলে
আমাদের এ জীবন ! – জীবনের বিহ্বলতা সয়ে
আমাদের দিন চলে,- আমদের রাত্রি তবু চলে;
তার ছিঁড়ে গেছে ,- তবু তাহারে বীণার মতো ক’রে
বাজাই ,- যে প্রেম চলিয়া গেছে তারি হাত ধ’রে !
কারণ , সূর্যের চেয়ে, আকাশের নক্ষত্রের থেকে
প্রেমের প্রাণের শক্তি বেশি;- তাই রাখিয়াছে ঢেকে
পাখির মায়ের মতো প্রেম এসে আমাদের বুকে !
সুস্থ ক’রে দিয়ে গেছে আমাদের রক্তের অসুখ !-
পাখির শিশুর মতো যখন প্রেমেরে ডেকে ডেকে
রাতের গুহার বুকে ভালোবেসে লুকায়েছি মুখ,-
ভোরের আলোর মতো চোখের তারায় তারে দেখে !-
প্রেম কি আসেনি তবু ? –তবে তার ইশারা আসুক!
প্রেম কি চলিয়া যায় প্রানেরে জলের ঢেউয়ে ছিঁড়ে !
ঢেউয়ের মতন তবু তার খোঁজে প্রাণ আসে ফিরে !
যত দিন বেঁচে আছি আলেয়ার মতো আলো নিয়ে ,-
তুমি চ’লে আস প্রেম, - তুমি চ’লে আস কাছে প্রিয়ে !
নক্ষত্রের বেশি তুমি, - নক্ষত্রের আকাশের মতো !
আমরা ফুরায়ে যাই ,- প্রেম তুমি হও না আহত !
বিদ্যুতের মতো মোরা মেঘের গুহার পথ দিয়ে
চ’লে আসি ,- চ’লে যাই ,- আকাশের পারে ইতস্তত !-
ভেঙে যাই ,- নিভে যাই ,- আমরা চলিতে গিয়ে গিয়ে !
আকাশের মতো তুমি ,- আকাশে নক্ষত্র আছে যত ,-
তাদের সকল আলো একদিন নিভে গেলে পরে,-
তুমিও কি ডুবে যাবে, ওগো প্রেম, পশ্চিম সাগরে !
জীবনের মুখে চেয়ে সেইদিনো রবে জেগে ,- জানি
জীবনের বুকে এসে মৃত্যু যদি উড়ায় উড়ানি ,-
ঘুমন্ত ফুলের মনো নিবন্ত বাতির মতো ঢেলে
মৃত্যু যদি জীবনেরে রেখে যায় ,- তুমি তারে জ্বেলে
চোখের তারার’পরে তুলে লবে সেই আলোখানি !
সময় ভাসিয়া যাবে ,- দেবতা মরিবে অবহেলে ,-
তবুও দিনের মেঘ আঁধার রাত্রির মেঘ ছানি
চুমো খাবে !- মানুষের সব ক্ষুধা আর শক্তি লয়ে
পূর্বের সমুদ্র ওই পশ্চিম সাগরে যাবে বয়ে !
সকল ক্ষুধার আগে তোমার ক্ষুধায় ভরে মন !
সকল শক্তির আগে প্রেম তুমি ,- তোমার আসন
সকল স্থলের’পরে,-সকল জলের’পরে আছে !
যেইখানে কিছু নাই সেখানেও ছায়া পড়িয়াছে
হে প্রেম তোমার ! – যেইখানে শব্দ নাই তুমি আলোড়ন
তুলিয়াছ !- অঙ্কুরের মতো তুমি,- যাহা ঝরিয়াছে
আবার ফুটাও তারে !- তুমি ঢেউ ,- হাওয়ার মতন !
আগুনের মতো তুমি আসিয়াছ অন্তরের কাছে !
আশার ঠোঁটের মতো নিরাশার ভিজে চোখ চুমি
আমার বুকের’পরে মুখ রেখে ঘুমায়েছ তুমি !
জীবন হয়েছে এক প্রার্থনার গানের মতন
তুমি আছ ব’লে প্রেম,- গানের ছন্দের মতো মন
আলো আর অন্ধকারে দুলে ওঠে তুমি আছ ব’লে!
হৃদয় গন্ধের মতো –হৃদয় ধূপের মতো জ্ব’লে
ধোঁয়ার চামর তুলে তোমারে যে করিছে ব্যজন !
ওগো প্রেম ,-বাতাসের মতো যেই দিকে যাও চ’লে
আমারে উড়ায়ে লও আগুনের মতন তখন !
আমি শেষ হব শুধু , ওগো প্রেম , তুমি শেষ হলে !
তুমি যদি বেঁচে থাকো ,- জেগে রবো আমি এই পৃথিবীর’পর,-
যদিও বুকের’পরে রবে মৃত্যু ,- মৃত্যুর কবর !
তবুও ,- সিন্ধুর জল-সিন্ধুর ঢেউয়ের মতো বয়ে
তুমি চ’লে যাও প্রেম ;- একবার বর্তমান হয়ে ,-
তারপর , আমাদের ফেলে যাও পিছনে –অতীতে,-
স্মৃতির হাড়ের মাঠে ,- কার্তিকের শীতে !
অগ্রসর হয়ে তুমি চলিতেছ ভবিষ্যৎ লয়ে –
আজো যারে দেখ নাই তাহারে তোমার চুমো দিতে
চ’লে যাও !- দেহের ছায়ার মতো তুমি যাও রয়ে ,-
আমরা ধরেছি ছায়া ,-প্রেমেরে তো পারিনি ধরিতে !
ধ্বনি চ’লে গেছে দূরে ,- প্রতিধ্বনি পিছে প’ড়ে আছে ;-
আমরা এসেছি সব ,- আমরা এসেছি তার কাছে !
একদিন-একরাত করেছি প্রেমের সাথে খেলা !
একরাত- একদিন করেছি মৃত্যুর অবহেলা ।
একদিন-একরাত ;- তারপর প্রেম গেছে চ’লে ,-
সবাই চলিয়া যায় ,- সকলের যেতে হয় ব’লে
তাহারো ফুরাল রাত !- তাড়াতাড়ি প’ড়ে গেল বেলা
প্রেমেরও যে !- একরাত আর একদিন সাঙ্গ হলে
পশ্চিমের মেঘে আলো একদিন হয়েছে সোনেলা !
আকাশে পুবের মেঘে রামধনু গিয়েছিল জ্ব’লে
একদিন ;- রয় না কিছুতে তবু ,- সব শেষ হয় ,-
সময়ের আগে তাই কেটে গেল প্রেমের সময় !
একদিন- একরাত প্রেমেরে পেয়েছি তবু কাছে !-
আকাশ চলেছে ,- তার আগে আগে প্রেম চলিয়াছে !
সকলের ঘুম আছে- ঘুমের মতন মৃত্যু বুকে
সকলের ;- নক্ষত্রও ঝ’রে যায় মনের অসুখে ;-
প্রেমের পায়ের শব্দ তবুও আকাশে বেঁচে আছে !
সকল ভুলের মাঝে যায় নাই কেউ ভুলে-চুকে
হে প্রেম তোমারে !-মৃতেরা আবার জাগিয়াছে !-
যে ব্যথা মুছিতে এসে পৃথিবীর মানুষের মুখে
আরো ব্যথা-বিহ্বলতা তুমি এসে দিয়ে গেলে তারে ,-
ওগো প্রেম ,- সেই সব ভুলে গিয়ে কে ভুলিতে পারে !
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন