সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

নজরুল কবিতা


মহর্‌রম

নীল সিয়া আসমা লালে লাল দুনিয়া,–
‘আম্মা! লাল তেরি খুন কিয়া খুনিয়া’।
কাঁদে কোন্ ক্রদসী কারবালা ফোরাতে,
সে কাঁদনে আঁসু আনে সীমারেরও ছোরাতে!
রুদ্র মাতম্ ওঠে দুনিয়া দামেশকে–
‘জয়নালে পরাল এ খুনিয়ারা বেশ কে?
‘হায় হায় হোসেনা’ ওঠে রোল ঝন্‌ঝায়,
তল্‌ওয়ার কেঁপে ওঠে এজিদেরো পঞ্জায়!
উন্‌মাদ ‘দুলদুল্’ ছুটে ফেরে মদিনায়,
আলি-জাদা হোসেনের দেখা হেথা যদি পায়!
মা ফাতেমা আস্‌মানে কাঁদে খুলি কেশপাশ,
বেটাদের লাশ নিয়ে বধূদের শ্বেতবাস!
রণে যায় কাসিম্ ঐ দু’ঘড়ির নওশা,
মেহেদির রঙটুকু মুছে গেল সহসা!
‘হায় হায়’ কাঁদে বায় পূরবী ও দখিনা–
‘কঙ্কণ পঁইচি খুলে ফেলো সকিনা!’
কাঁদে কে রে কোলে করে কাসিমের কাটা-শির?
খান্‌খান্ খুন হয়ে ক্ষরে বুক-ফাটা নীর!
কেঁদে গেছে থামি হেথা মৃত্যু ও রুদ্র,
বিশ্বের ব্যথা যেন বালিকা এ ক্ষুদ্র!
গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদে কচি মেয়ে ফাতিমা,
‘আম্মা গো পানি দাও ফেটে গেল ছাতি মা!’
নিয়ে তৃষা সাহারার, দুনিয়ার হাহাকার,
কারবালা-প্রান্তরে কাঁদে বাছা আহা কার!
দুই হাত কাটা তবু শের-নর আব্বাস
পানি আনে মুখে, হাঁকে দুশ্‌মনও ‘সাব্বাস’!
দ্রিম্ দ্রিম্ বাজে ঘন দুন্দুভি দামামা,
হাঁকে বীর ‘শির দেগা, নেহি দেগা আমামা!’
মা’র থনে দুধ নাই, বাচ্চারা তড়্‌পায়!
জিভ চুষে কচি জান থাকে কিরে ধড়্‌টায়?
দাউদাউ জ্বলে শিরে কারবালা-ভাস্কর,
কাঁদে বানু–’পানি দাও, মরে জাদু আস্‌গর!’
কলিজা কাবাব সম ভুনে মরু-রোদ্দুর,
খাঁ খাঁ করে কার্‌বালা, নাই পানি খর্জুর,
পেল না তো পানি শিশু পিয়ে গেল কাঁচা খুন,
ডাকে মাতা, –পানি দেবো ফিরে আয় বাছা শুন্!
পুত্রহীনার আর বিধবার কাঁদনে
ছিঁড়ে আনে মর্মের বত্রিশ বাঁধনে!
তাম্বুতে শয্যায় কাঁদে একা জয়নাল,
‘দাদা! তেরি হর্ কিয়া বর্‌বাদ্ পয়মাল!’
হাইদরি-হাঁক হাঁকি দুল্‌দুল্-আস্‌ওয়ার
শম্‌শের চম্‌কায় দুশমনে ত্রাস্‌বার!
খসে পড়ে হাত হতে শত্রুর তরবার,
ভাসে চোখে কিয়ামতে আল্লার দরবার।
নিঃশেষ দুশ্‌মন্; ওকে রণ-শ্রান্ত
ফোরাতের নীরে নেমে মুছে আঁখি-প্রান্ত?
কোথা বাবা আস্‌গর্? শোকে বুক-ঝাঁঝরা
পানি দেখে হোসনের ফেটে যায় পাঁজরা!
ধুঁকে ম’লো আহা তবু পানি এক কাৎরা
দেয়নি রে বাছাদের মুখে কম্‌জাত্‌রা!
অঞ্জলি হতে পানি পড়ে গেল ঝর্-ঝর্
লুটে ভূমে মহাবাহু খঞ্জর-জর্জর!
হল্‌কুমে হানে তেগ ও কে বসে ছাতিতে?–
আফ্‌তাব ছেয়ে নিল আঁধিয়ারা রাতিতে!
আস্‌মান ভরে গেল গোধূলিতে দুপরে,
লাল নীল খুন ঝরে কুফরের উপরে!
বেটাদের লোহু-রাঙা পিরাহান-হাতে, আহ্–
‘আরশের পায়া ধরে কাঁদে মাতা ফাতেমা,
‘এয়্ খোদা বদ্‌লাতে বেটাদের রক্তের
মার্জনা করো গোনা পাপী কম্‌বখ্‌তের!’
কত মোহর্‌রম্ এল্ গেল চলে বহু কাল–
ভুলিনি গো আজো সেই শহীদের লোহু লাল!
মুস্‌লিম্! তোরা আজ জয়নাল আবেদিন,
‘ওয়া হোসেনা-ওয়া হোসেনা’ কেঁদে তাই যাবে দিন!
ফিরে এল আজ সেই মোহর্‌রম মাহিনা,–
ত্যাগ চাই, মর্সিয়া-ক্রন্দন চাহি না!
উষ্ণীষ কোরানের, হাতে তেগ্ আরবির,
দুনিয়াতে নত নয় মুস্‌লিম কারো শির;–
তবে শোনো ঐ শোনো বাজে কোথা দামামা,
শম্‌শের হাতে নাও, বাঁধো শিরে আমামা!
বেজেছে নাকাড়া, হাঁকে নকিবের তূর্য,
হুশিয়ার ইস্‌লাম, ডুবে তব সূর্য!
জাগো ওঠো মুস্‌লিম, হাঁকো হাইদরি হাঁক।
শহীদের দিনে সব-লালে-লাল হয়ে যাক!
নওশার সাজ নাও খুন-খচা আস্তিন,
ময়দানে লুটাতে রে লাশ এই খাস দিন।
হাসানের মতো পি’ব পিয়ালা সে জহরের,
হোসেনের মতো নিব বুকে ছুরি কহরের;
আস্‌গর সম দিব বাচ্চারে কোর্‌বান,
জালিমের দাদ নেবো, দেবো আজ গোর জান!
সকিনার শ্বেতবাস দেব মাতা কন্যায়,
কাসিমের মতো দেবো জান রুধি অন্যায়!
মোহর্‌রম্! কারবালা! কাঁদো ‘হায় হোসেনা!’
দেখো মরু-সূর্যে এ খুন যেন শোষে না!
———————————–
আরশ–খোদার সিংহাসন। আম্মা –মা। লা’ল–জাদু। মাতম –হাহা ক্রন্দন। দুনিয়া-দামেশকে– দামেশক-রূপ দুনিয়ায়। আমামা–শিরস্ত্রাণ। বানু –আসগরের মাতা। আসগর –ইমাম হোসেনের শিশুপুত্র। জয়নাল –ইমাম হোসেনের পুত্র। বরবাদ –নষ্ট। পয়মাল –ধ্বংস। দুলদুল-আসওয়ার –’দুলদুল’ ঘোড়ার সওয়ার ইমাম হোসেন। এক কাৎরা –এক বিন্দু। কমজাতরা –নীচমনাগণ। হলকুম –কণ্ঠ। তেগ –তরবারি। আফতাব –সূর্য। কমবখ্‌ত –হতভাগ্য৷ মর্সিয়া –শোক-গীতি। শম্‌শের –তরবারি। নকিব –তূর্যবাদক। জহর –বিষ। কহর –অভিশাপ। দাদ –প্রতিশোধ।

কোরবানী

ওরে   হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্‌বোধন।
        দুর্বল! ভীরু! চুপ রহো, ওহো খাম্‌খা ক্ষুব্ধ মন!
             ধ্বনি ওঠে রণি দূর বাণীর,–
             আজিকার এ খুন কোর্‌বানির!
             দুম্বা-শির      রুম্-বাসীর
        শহীদের শির-সেরা আজি। –রহমান কি রুদ্র নন?
             বাস্‍! চুপ খামোশ রোদন!
আজ  শোর ওঠে জোর ‘খুন দে, জান দে, শির দে বৎস’ শোন!
ওরে   হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্‌বোধন।
ওরে   হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্‌বোধন।
             খঞ্জর মারো গর্দানেই,
              পঞ্জরে আজি দরদ নেই,
              মর্দানি’ই পর্দা নেই
        ডর্‌তা নেই আজ খুন্-খারাবিতে রক্ত-লুব্ধ মন!
              খুনে  খেল্‌ব খুন্-মাতন!
দুনো  উন্মাদনাতে সত্য মুক্তি আন্‌তে যুঝ্‌র রণ।
ওরে   হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্‌বোধন।
 ওরে   হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্‌বোধন।
             চড়েছে খুন আজ খুনিয়ারার
             মুস্‌লিমে সারা দুনিয়াটার।
             ‘জুল্‌ফেকার’ খুল্‌বে তার
     দু’ধারী ধার্‌ শেরে-খোদার রক্তে-পূত-বদন!
             খনে আজকে রুধ্‌ব মন!
ওরে  শক্তি-হস্তে মুক্তি, শক্তি রক্তে সুপ্ত শোন্!
ওরে   হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্‌বোধন।
ওরে   হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্‌বোধন।
             আস্তানা সিধা রাস্তা নয়,
             ‘আজাদি’ মেলে না পস্তানোয়!
             দস্তা নয় সে     সস্তা নয়!
     হত্যা নয় কি মৃত্যুও? তবে রক্ত-লুব্ধ কোন্
             কাঁদে-শক্তি-দুঃস্থ শোন্–
‘এয়্‌  ইব্‌রাহিম্ আজ কোর্‌বানি কর শ্রেষ্ঠ পুত্রধন!’
ওরে   হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্‌বোধন।
          এ তো নহে লোহু তরবারের
          ঘাতক জালিম জোর্‌বারের!
          কোরবানের জোর-জানের
     খুন এ যে, এতে গোর্দা ঢের রে, এ ত্যাগে ‘বুদ্ধ’ মন!
          এতে    মা রাখে পুত্র পণ্!
তাই  জননী হাজেরা বেটারে পরাল বলির পূত বসন!
ওরে   হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্‌বোধন।
ওরে   হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্‌বোধন।
          এই দিনই ‘মীনা’-ময়দানে
          পুত্র-স্নেহের গর্দানে
          ছুরি হেনে খুন ক্ষরিয়ে নে
     রেখেছে আব্বা ইব্‌রাহিম্ সে আপনা রুদ্র পণ!
     ছি ছি! কেঁপো না ক্ষুদ্র মন!
আজ  জল্লাদ নয়, প্রহলাদ সম মোল্লা খুন-বদন!
ওরে   হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্‌বোধন।
ওরে   হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্‌বোধন।
        দ্যাখ্    কেঁপেছে ‘আরশ’ আস্‌মানে,
                  মন-খুনি কি রে রাশ মানে?
                  ত্রাস প্রাণে?-তবে রাস্তা নে‍!
    প্রলয়- বিষাণ কিয়ামতে তবে বাজাবে কোন্ বোধন?
    সেকি       সৃষ্টি-সংশোধন?
ওরে  তাথিয়া তাথিয়া নাচে ভৈরব বাজে ডম্বরু শোন্!–
ওরে   হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্‌বোধন।
ওরে   হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্‌বোধন।
          মুস্‌লিম-রণ-ডঙ্কা সে,
          খুন্ দেখে করে শঙ্কা কে?
          টঙ্কারে অসি ঝঙ্কারে
ওরে  হুঙ্কারে, ভাঙি গড়া ভীম কারা লড়ব রণ-মরণ!
     ঢালে    বাজ্‌বে ঝন্-ঝনন!
ওরে  সত্য মুক্তি স্বাধীনতা দেবে এই সে খুন-মোচন!
ওরে   হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্‌বোধন।
ওরে   হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্‌বোধন।
          জোর চাই আর যাচ্‌না নয়
          কোরবানি-দিন আজ না ওই?
          বাজ্‌না কই? সাজ্‌না কই?
কাজ না আজিকে জান্ মাল দিয়ে মুক্তির উদ্ধরণ?
          বল্– ‘যুঝ্‌ব জান্ ভি পণ!’
ঐ   খুনের খুঁটিতে কল্যাণ-কেতু, লক্ষ্য ঐ তোরণ!
আজ  আল্লার নামে জান কোরবানে ঈদের পূত বোধন।
ওরে   হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্‌বোধন।
———————————–
রহমান– করুণাময়; খামোশ– নীরব। গর্দানে– স্কন্ধে; জান্নাত– স্বর্গ; জুলফেকার– মহাবীর হজরত আলীর বিশ্বত্রাস তরবারি; শের-খোদা– খোদার সিংহ; হজরত আলীকে এই গৌরাবান্বিত নামে অভিহিত করা হয়। জোরবার– বলদৃপ্ত; জোর-জান– মহাপ্রাণ; আজাদি– মুক্তি; আব্বা– বাবা; ইবরাহিম– Abraham. হাজেরা– হজরত ইবরাহীমের স্ত্রী।

খেয়াপারের তরণী

যাত্রীরা রাত্তিরে হতে এল খেয়া পার,
বজ্রেরি তূর্যে এ গর্জেছে কে আবার?
প্রলয়েরি আহ্বান ধ্বনিল কে বিষাণে!
ঝন্‌ঝা ও ঘন দেয়া স্বনিল রে ঈশানে!
নাচে পাপ-সিন্ধুতে তুঙ্গ তরঙ্গ!
মৃত্যুর মহানিশা রুদ্র উলঙ্গ!
নিঃশেষে নিশাচর গ্রাসে মহাবিশ্বে,
ত্রাসে কাঁপে তরণীর পাপী যত নিঃস্বে।
তমসাবৃতা ঘোরা ‘কিয়ামত’ রাত্রি,
খেয়া-পারে আশা নাই ডুবিল রে যাত্রী!
দমকি দমকি দেয়া হাঁকে কাঁপে দামিনী,
শিঙ্গার হুঙ্কারে থরথর যামিনী!
লঙ্ঘি এ সিন্ধুরে প্রলয়ের নৃত্যে
ওগো কার তরী ধায় নির্ভীক চিত্তে–
অবহেলি জলধির ভৈরব গর্জন
প্রলয়ের ডঙ্কার ওঙ্কার তর্জন!
পুণ্য-পথের এ যে যাত্রীরা নিষ্পাপ,
ধর্মেরি বর্মে সু-রক্ষিত দিল্ সাফ!
নহে এরা শঙ্কিত বজ্র নিপাতেও
কাণ্ডারী আহ্‌মদ তরী ভরা পাথেয়।
আবুবকর উস্‌মান উমর আলি হায়দর
দাঁড়ি যে এ তরণীর, নাই ওরে নাই ডর!
কাণ্ডারী এ তরীর পাকা মাঝি মাল্লা,
দাঁড়ি-মুখে সারি-গান –লা-শরিক আল্লাহ!
‘শাফায়ত’-পাল-বাঁধা তরণীর মাস্তুল,
‘জান্নাত্’ হতে ফেলে হুরি রাশ্ রাশ্ ফুল।
শিরে নত স্নেহ-আঁখি মঙ্গল দাত্রী,
গাও জোরে সারি-গান ও-পারের যাত্রী।
বৃথা ত্রাসে প্রলয়ের সিন্ধু ও দেয়া-ভার,
ঐ হলো পুণ্যের যাত্রীরা খেয়া পার।
————————–
আহমদ– মোহাম্মদ (সা)। লা-শরিক আল্লাহ– ঈশ্বর ভিন্ন অন্য কেহ উপাস্য নাই। শাফায়ত– পরিত্রাণ; জান্নাত– স্বর্গ;

শাত-ইল-আরব

শাতিল্ আরব! শাতিল্ আরব!! পূত যুগে যুগে তোমার তীর।
শহীদের লোহু, দিলিরের খুন ঢেলেছে যেখানে আরব-বীর।
     যুঝেছে এখানে তুর্কি-সেনানী,
     য়ুনানি, মিস্‌রি, আর্‌বি, কেনানি–
লুটেছে এখানে মুক্ত আজাদ্‌ বেদুঈন্‌দের চাঙ্গা শির!
                                  নাঙ্গা-শির্–
শম্‌শের হাতে, আঁসু-আঁখে হেথা মূর্তি দেখেছি বীর-নারীর!
শাতিল্ আরব! শাতিল্ আরব!! পূত যুগে যুগে তোমার তীর।
     ‘কুত-আমারা’র রক্তে ভরিয়া
     দজ্‌লা এনেছে লোহুর দরিয়া;
     উগারি সে খুন তোমাতে দজ্‌লা নাচে ভৈরব ‘মস্তানি’র।
                                                         এস্তা-নীর
গর্জে রক্ত-গঙ্গা ফোরাত, –’শাস্তি দিয়েছি গোস্তাখির!’
দজ্‌লা-ফোরাত-বাহিনী শাতিল! পূত যুগে যুগে তোমার তীর।
     বহায়ে তোমার লোহিত বন্যা
     ইরাক আজমে করেছ ধন্যা;–
     বীর-প্রসূ দেশ হলো বরেণ্যা মরিয়া মরণ মর্দমির!
                                                 মর্দ বীর
সাহারায় এরা ধুঁকে মরে তবু পরে না শিকল পদ্ধতির।
শাতিল্-আরব! শাতিল্-আরব্! পূত যুগে যুগে তোমার তীর!
     দুশ্‌মন্-লোহু ঈর্ষায়-নীল
     তব তরঙ্গে করে ঝিলমিল্,
বাঁকে বাঁকে রোষে মোচড় খেয়েছ পিয়ে নীল খুন পিণ্ডারির!
                                                জিন্দা বীর
‘জুলফিকার’ আর ‘হায়দরি’ হাঁক হেথা আজো হজরত্ আলীর-
শাতিল্-আরব!-শাতিল্-আরব!! জিন্দা রেখেছে তোমার তীর।
     ললাটে তোমার ভাস্বর টীকা
     বস্‌রা-গুলের বহ্নিতে লিখা–
এ যে বসোরার খুন-খারাবি গো রক্ত-গোলাব-মঞ্জরীর!
                                              খঞ্জরীর
খঞ্জরে ঝরে খর্জুর সম হেথা লাখো দেশ-ভক্ত-শির!
শাতিল্-আরব! শাতিল্-আরব!! পূত যুগে তোমার তীর।
     ইরাক-বাহিনী! এ যে গো কাহিনী,–
     কে জানিত কবে বঙ্গ-বাহিনী
তোমারও দুঃখে ‘জননী আমার!’ বলিয়া ফেলিবে তপ্ত নীর!
                                           রক্ত-ক্ষীর–
পরাধীনা! একই ব্যথায় ব্যথিত ঢালিল দু-ফোঁটা ভক্ত-বীর।
শহীদের দেশ! বিদায়! বিদায়!! এ অভাগা আজ নোয়ায় শির!
—————————–
শাতিল আরব– আরব দেশের একটি নদীর নাম। দিলির– অসম সাহসী; য়ুয়ানি– য়ুনান দেশের অধিবাসী; মিস্‌রিা– মিশরের অধিবাসী; কেনানি– কেনানের অধিবাসী; চাঙ্গা– টাটকা; কুত-আমারা– কুতল-আমার নামক স্থান, যেখানে জেনারেল টাউনসেন্ড বন্দী হন।

রণভেরী

[গ্রীসের বিরুদ্ধে আঙ্গোরা-তুর্ক-গভর্ণমেন্ট যে যুদ্ধ চালাইতেছিলেন, সেই যুদ্ধে কামাল পাশার সাহায্যের জন্য ভারতবর্ষ হইতে দশ হাজার স্বেচ্ছা-সৈনিক প্রেরণের প্রস্তাব শুনিয়া লিখিত]
                   ওরে       আয়!
ঐ       মহা-সিন্ধুর পার হতে ঘন রণ-ভেরী শোনা যায়–
                 ওরে       আয়!
ঐ       ইস্‌লাম ডুবে যায়!
                 যত শয়তান
                 সারা ময়দান
জুড়ি    খুন তার পিয়ে হুঙ্কার দিয়ে জয়-গান শোন্ গায়!
          আজ   শখ করে জুতি-টক্করে
তোড়ে  শহীদের খুলি দুশ্‌মন পায় পায়–
                 ওরে আয়!
তোর    জান যায় যাক, পৌরুষ তোর মান যেন নাহি যায়!
ধরে     ঝন্‌ঝার ঝুঁটি দাপটিয়া শুরু মুস্‌লিম-পঞ্জায়!
          তোর   মান যায় প্রাণ যায়–
তবে    বাজাও বিষাণ, ওড়াও নিশান! বৃথা ভীরু সম্‌ঝায়!
          রণ-       দুর্মদ রণ চায়!
                ওরে   আয়!
ঐ       মহা-সিন্ধুর পার হতে ঘন রণ-ভেরী শোনা যায়!
                ওরে   আয়!
ঐ       ঝননননন রণ-ঝনঝন ঝন্‌ঝনা শোনা যায়!
শুনি     এই ঝন্‌ঝনা-ব্যঞ্জনা নেবে গঞ্জনা কে রে হায়?
                ওরে   আয়!
          তোর       ভাই ম্লান চোখে চায়,
                মরি    লজ্জায়,
               ওরে    সব যায়,
তবু      কব্‌জায় তোর শম্‌শের নাহি কাঁপে আফ্‌সোসে হায়?
                রণ-    দুন্দুভি শুনি খুন-খুবি
নাহি      নাচে কি রে তোর মরদের ওরে দিলিরের গোর্দায়?
                    ওরে    আয়
মোরা    দিলাবার খাঁড়া তলোয়ার হাতে আমাদেরি শোভা পায়!
তারা     খিঞ্জির যারা জিঞ্জির-গলে ভূমি চুমি মূরছায়!
                  আরে   দূর দূর! যত কুক্কুর
আসি    শের-বব্বরে লাথি মারে ছি ছি ছাতি চড়ে! হাতি
                  ঘা‌’ল হবে ফেরু-ঘায়?
ঐ       ঝননননন রণঝনঝন ঝন্‌ঝনা শোনা যায়!
                 ওরে    আয়!
বোলে   দ্রিম্‌ দ্রিম্ তানা দ্রিম, দ্রিম্ ঘন রণ-কাড়া-নাকাড়ায়!
ঐ                    শের-নর হাঁকড়ায়–
                  ওরে       আয়!
                  ছোড়্   মন-দুখ,
                  হোক   কন্দুক
ঐ       বন্দুক তোপ, সন্দুক তোর পড়ে থাক, স্পন্দুক বুক ঘা’য়!
          নাচ্ তাতা থৈ থৈ তাতা থৈ–
থৈ       তা‌ণ্ডব, আজ পাণ্ডব সম খাণ্ডব-দাহ চাই!
                      ওরে       আয়!
কর      কোর্‌বান আজ তোর জান দিল্ আল্লার নামে ভাই।
ঐ       দীন্ দীন্-রব আহব বিপুল বসুমতী ব্যোম ছায়!
                শেল–   গর্জন
                করি     তর্জন
হাঁকে, বর্জন নয় অর্জন আজ, শির তোর চায় মায়!
            সব   গৌরব যায় যায়;
বোলে দ্রিম্ দ্রিম্ তানা দ্রিম্ দ্রিম্ ঘন রণ-কাড়া-নাকাড়ায়!
                   ওরে  আয় !
ঐ   কড়কড় বাজে রণ-বাজা, সাজ সাজ রণ-সাজ্জায়!
                  ওরে  আয়!
মুখ            ঢাকিবি কি লজ্জায়?
                   হুর্        হুর্‌রে।
                  কত       দূর রে
   সেই    পুর রে যথা খুন-খোশ্‌রোজ খেলে হর্‌রোজ দুশ্‌মন-খুনে ভাই!
             সেই   বীর-দেশে চল্ বীর-বেশে,
   আজ    মুক্ত দেশে রে মুক্তি দিতে রে বন্দীরা ঐ যায়!
                ওরে     আয়!
   বল্‌        ‘জয় সত্যম্ পুরুযোত্তম’, ভীরু যারা মার খায়!
নারী  আমাদেরি শুনি রণ-ভেরী হাসে খলখল হাত-তালি দিয়ে রণে ধায়!
                মোরা     রণ চাই রণ চাই,
   তবে    বাজহ দামামা, বাঁধই আমামা, হাথিয়ার পাঞ্জায়!
   মোরা   সত্য ন্যায়ের সৈনিক, খুন-গৈরিক বাস গা’য়।
              ওরে     আয়!
ঐ   কড়কড় বাজে রণ-বাজা, সাজ সাজ রণ-সজ্জায়!
          ওরে     আয়!
অব–       রুদ্ধের দ্বারে যুদ্ধের হাঁক নকিব ফুকারি যায়!
         তোপ্ দ্রুম্ দ্রুম্ গান গায়!
                  ওরে     আয়!
ঐ     ঝননরণন খঞ্জর-ঘাত পঞ্জরে মূরছায়!
                 হাঁকো হাইদার,
                 নাই নাই ডর,
ঐ     ভাই তোর ঘুর-চর্খীর সম খুন খেয়ে ঘুর্ খায়!
                ঝুটা  দৈত্যেরে
                নাশি  সত্যেরে
দিবি    জয়-টীকা তোরা, ভয় নাই ওরে ভয় নাই হত্যায়!
                ওরে     আয়!
মোরা    খুন্‌-জোশি বীর, কঞ্জুশি লেখা আমাদের খুনে নাই!
দিয়ে    সত্য ও ন্যায়ে বাদশাহি, মোরা জালিমের খুন খাই!
          মোরা     দুর্মদ, ভর্‌পুর্ মদ
খাই     ইশ্‌কের, ঘাত-শম্‌শের ফের নিই বুক নাঙ্গায়!
          লাল   পল্টন মোরা সাচ্চা,
মোরা    সৈনিক, মোরা শহীদান বীর বাচ্চা,
         মরি   জালিমের দাঙ্গায়!
মোরা অসি বুকে বরি হাসি মুখে মরি জয় স্বাধীনতা গাই!
          ওরে     আয়!
ঐ   মহা-সিন্ধুর পার হতে ঘন রণ-ভেরী শোনা যায়!!
——————————-
শম্‌শের– তরবারি।  খুন-খুবি– রক্তোন্মত্ততা; দিলির– সাহসী, নির্ভীক; দিলবার– প্রাণবন্তা। জিঞ্জির– শিকল; শের-বববরে– সিংহ;  শের-নর– পুরুষসিংহ; হাঁকাড়ায়– গর্জন করিতেছি;  কোরবান– উৎসর্গ; খুন-খোশ-রোজ– রক্ত-মহোৎসব। হররোজ– প্রতিদিন; আমামা – শিরস্ত্রাণ; নকিব– তূর্যবাদক; হাইদার– মহাবীর হজরত আলীর হাঁক; খুন-জোশ– রক্ত-পাগলামি; কঞ্জুশি– কৃপণতা; ইশকের– প্রেমের; শহীদান– Martyrs.

আনোয়ার

[স্থান– প্রহরী–বেষ্টিত অন্ধকার কারাগৃহ, কনস্ট্যান্টিনোপ্‌ল্‌।
কাল–অমাবস্যার নিশীথ রাত্রি।]
[চারিদিকে নিস্তব্ধ নির্বাক। সেই মৌনা নিশীথিনীকে ব্যথা দিতেছিল শুধু কাফ্রি-সাস্ত্রীর পায়চারির বিশ্রী খট্‌খট্ শব্দ। ঐ জিন্দানখানায় মহাবাহু আনোয়ারের জাতীয়-সৈন্যদলের সহকারী এক তরুণ সেনানী বন্দী। তাহার কুঞ্চিত দীর্ঘ কেশ, ডাগর চোখ, সুন্দর গঠন– সমস্ত-কিছুতে যেন একটা ব্যথিত-বিদ্রোহের তিক্ত-ক্রন্দন ছলছল করিতেছিল। তরুণ প্রদীপ্ত মুখমণ্ডলে চিন্তার রেখাপাতে তাহাকে তাহার বয়স অপেক্ষা অনেকটা বেশি বয়স্ক বোধ হইতেছিল।
সেইদিনই ধামা-ধরা সরকারের কোর্ট-মার্শালের বিচারে নির্দ্ধারিত হইয়া গিয়াছে যে, পরদিন নিশিভোরে তরুণ সেনানীকে তোপের মুখে উড়াইয়া দেওয়া হইবে।
আজ হতভাগ্যের সেই মুক্তি-নিশীথ, জীবনের সেই শেষরাত্রি। তাহার হাতে, পায়ে, কটিদেশে, গর্দানে উৎপীড়নের লৌহ-শৃঙ্খল। শৃঙ্খল-ভারাতুর তরুণ সেনানী স্বপ্নে তাহার ‘মা’-কে দেখিতেছিল। সহসা চীৎকার করিয়া সে জাগিয়া উঠল। তাহার পর চারিদিকে কাতর নয়নে একবার চাহিয়া দেখিল, কোথাও কেহ নাই। শুধু হিমানি-সিক্ত বায়ু হা হা স্বরে কাঁদিয়া গেল, ‘হায় মাতৃহারা!’
স্বদেশবাসীর বিশ্বাসঘাতকতা স্মরণ করিয়া তরুণ সেনানী ব্যর্থ-রোষে নিজের বাম বাহু নিজে দংশন করিয়া ক্ষত-বিক্ষত করিতে লাগিল। কারাগৃহের লৌহ-শলাকায় তাহার শৃঙ্খলিত দেহভার বারেবারে নিপতিত হইয়া কারা-গৃহ কাঁপাইয়া তুলিতেছিল।
এখন তাহার অস্ত্র-গুরু আনোয়ারকে মনে পড়িল। তরুণ বন্দী চীৎকার করিয়া উঠিল, ‘আনোয়ার!’–]
              আনোয়ার!      আনোয়ার!
দিলাওয়ার তুমি, জোর তলওয়ার হানো, আর
নেস্ত-ও-নাবুদ করো, মারো যত জানোয়ার!
             আনোয়ার! আফসোস্!
             বখতেরই সাফ্ দোষ,
রক্তেরও নাই ভাই আর সে যে তাপ জোশ,
ভেঙে গেছে শম্‌শের–পড়ে আছে খাপ কোষ!
            আনোয়ার! আফসোস্!

            আনোয়ার! আনোয়ার!
সব যদি সুম্‌সাম, তুমি কেন কাঁদো আর?
দুনিয়াতে মুসলিম আজ পোষা জানোয়ার!
            আনোয়ার! আর না!–
            দিল্ কাঁপে কার না?
তল্‌ওয়ারে তেজ নাই! –তুচ্ছ স্মার্ণা,
ঐ কাঁপে থরথর মদিনার দ্বার না?
            আনোয়ার! আর না!
 
           আনোয়ার! আনোয়ার!
বুক ফেড়ে আমাদের কলিজাটা টানো, আর
খুন করো –খুন করো ভীরু যত জানোয়ার!
           আলোয়ার! জিঞ্জির–
          পরা মোরা খিঞ্জির!
শৃঙ্খলে বাজে শোনো রোণা রিণ-ঝিণ্ কির,–
নিবু নিবু ফোয়ারা বহ্নির ফিন্‌কির!
          গর্দানে জিঞ্জির!

          আনোয়ার! আনোয়ার!
দুর্বল্ এ গিদ্‌ধড়ে কেন তড়্‌পানো আর?
জোরওয়ার শের কই? জের্‌বার জানোয়ার!
         আনোয়ার! মুশ্‌কিল
         জাগা কঞ্জুশ্-দিল,
ঘিরে আসে দাবানল তবু নাই হুঁশ তিল!
ভাই আজ শয়তান ভাই-এ মারে ঘুষ কিল!
         আনোয়ার! মুশ্‌কিল!

         আনোয়ার! আনোয়ার!
বেইমান মোরা, নাই জান আধ-খানও আর।
কোথা খোঁজো মুস্‌লিম? –শুধু বুনো জানোয়ার!
        আনোয়ার! সব শেষ!–
        দেহে খুন অবশেষ!–
ঝুটা তেরি তলওয়ার ছিন্ লিয়া যব্ দেশ!
আওরত সম ছি ছি ক্রদন রব পেশ!!
       আনোয়ার! সব শেষ!

       আনোয়ার! আনোয়ার!
জনহীন এ বিয়াবানে মিছে পস্তানো আর!
আজো যারা বেঁচে আছে তারা খ্যাপা জানোয়ার!
       আনোয়ার! –কেউ নাই!
       হাথিয়ার? –সেও নাই!
দরিয়াও থম্‌থম্ নাই তাতে ঢেউ, ছাই!
জিঞ্জির গলে আজ বেদুঈন-দে'ও ভাই!
     আনোয়ার! কেউ নাই!

     আনোয়ার! আনোয়ার!
 যে বলে সে মুস্‌লিম– জিভ্ ধরে টানো তার!
 বেইমান জানে শুধু জানটা বাঁচানো সার!
      আনোয়ার! ধিক্কার!
      কাঁধে ঝুলি ভিক্ষার–
 তল্ওয়ারে শুরু যার স্বধীনতা শিক্ষার!
 যারা ছিল দুর্দম আজ তারা দিক্‌দার!
     আনোয়ার! ধিক্কার!

     আনোয়ার! আনোয়ার!
 দুনিয়াটা খুনিয়ার, তবে কেন মনো আর
 রুধিরের লোহু আঁখি? –শয়তানি জানো সার!
     আনোয়ার! পঞ্জায়
     বৃথা লোকে সম্‌ঝায়,

ব্যথা-হত বিদ্রোহী দিল্‌ নাচে ঝন্‌ঝায়,
খুন-খেগো তল্‌ওয়ার আজ শুধু রণ্ চায়,
   আনোয়ার! পঞ্জায়!
   আনোয়ার! আনোয়ার!
পাশা তুমি নাশা হও মুসলিম-জানোয়ার,
ঘরে যত দুশ্‌মন, পরে কেন হানো মার?–
   আনোয়ার! এসো ভাই!
   আজ সব শেষও যাই!–
 ইস্‌লামও ডুবে গেল, মুক্ত স্বদেশও নাই!-
 তেগ ত্যাজি বরিয়াছি ভিখারির বেশও তাই!
      আনোয়ার! এসো ভাই!!
[সহসা কাফ্রি সাস্ত্রীর ভীম চ্যালেঞ্জ্ প্রলয়-ডম্বরু-ধ্বনির মতো হুঙ্কার দিয়া উঠিল– ‘এয়্ নৌজওয়ান, হুঁশিয়ার!’ অধীর ক্ষোভে তিক্ত রোষে তরুণের দেহের রক্ত টগবগ করিয়া ফুটিয়া উঠিল! তাহার কটিদেশের, গর্দানের, পায়ের শৃঙ্খল খানখান হইয়া টুটিয়া গেল, শুধু হাতের শৃঙ্খল টুটিল না। সে সিংহ-শাবকের মতো গর্জন করিয়া উঠিল–]
এয়্ খোদা! এয়্ আলি! লাও মেরি তলোয়ার!
[সহসা তাহার ক্লান্ত আঁখির চাওয়ায় তুরস্কের বন্দিনী মাতৃ-মূর্তি ভাসিয়া উঠিল। ঐ মাতৃমূর্তির পার্শ্বেই তাহার মায়েরও শৃঙ্খলিত ভিখারিনি বেশ। তাঁদের দুইজনেরই চোখের কোণে দুই বিন্দু করিয়া করুণ অশ্রু। অভিমানী পুত্র অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া লইয়া কাঁদিয়া উঠিল–]
                           ও কে? ও কে ছল আর?
                           না-মা, মরা জানকে এ মিছে তর্‌সানো আর!
                           আনোয়ার! আনোয়ার!!
[কাপুরুষ প্রহরীর ভীম প্রহরণ বিনিদ্র বন্দী তরুণ সেনানীর পৃষ্ঠের উপর পড়িল। অন্ধ কারাগারের বন্ধ রন্ধ্রে রন্ধ্রে তাহারই আর্ত প্রতিধ্বনি গুমরিয়া ফিরিতে লাগিল-‘আঃ-আঃ-আঃ!’
আজ নিখিল বন্দী-গৃহে গৃহে ঐ মাতৃমুক্তিকামী তরুণেরই অতৃপ্ত কাঁদন ফরিয়াদ করিয়া ফিরিতেছে। যেদিন এ ক্রন্দন থামিবে, সেদিন সে-কোন্ অচিন্ দেশে থাকিয়া গভীর তৃপ্তির হাসি হাসিব জানি না! তখন হয়তো হারা-মা-আমার আমায় ‘তারার পানে চেয়ে চেয়ে’ ডাকবেন। আমিও হয়তো আবার আসিব। মা কি আমায় তখন নূতন নামে ডাকিবেন? আমার প্রিয়জন কি আমায় নূতন বাহুর ডোরে বাঁধিবে? আমার চোখ জলে ভরিয়া উঠিতেছে, আর কেন যেন মনে হইতেছে, ‘আসিবে সেদিন আসিবে!’]
———————————-
সুমসাম– নিঝঝুম। জিঞ্জির– শৃঙ্খল; খিঞ্জির– শূকর; রোণা– ক্রন্দন; জোরওয়ার– বলবান; শের– বাঘ; গিদ্‌ড়ে– শৃগাল; জোরবার– ক্ষত-বিক্ষত; কঞ্জুশ্-দিল– কৃপণ মন; বিয়াবান– মরুভূমি। হাথিয়ার– অস্ত্র; দিক্‌দার– তিক্ত-বিরক্ত; তেগ– তলোয়ার। তরসানো– দুঃখে দেওয়া।

কামাল পাশা

[তখন শরৎ-সন্ধ্যা। আস্‌মানের আঙিনা তখন কার্‌বালা ময়দানের মতো খুনখারাবির রঙে রঙিন। সেদিনকার মহা-আহবে গ্রীক-সৈন্য সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হইহা গিয়াছে। তাহাদের অধিকাংশ সৈন্যই রণস্থলে হত অবস্থায় পড়িয়া রহিয়াছে। বাকি সব প্রাণপণে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করিতেছে। তুরস্কের জাতীয় সৈন্যদলের কাণ্ডারী বিশ্বত্রাস মহাবাহু কামাল-পাশা মহাহর্ষে রণস্থল হইতে তাম্বুতে ফিরিতেছেন। বিজয়োন্মত্ত সৈন্যদল মহাকল্লোলে অম্বর-ধরণী কাঁপাইয়া তুলিতেছে। তাহাদের প্রত্যেকের বুকে পিঠে দুই জন করিয়া নিহত বা আহত সৈন্য বাঁধা। যাহারা ফিরিতেছে তাহাদেরও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গোলাগুলির আঘাতে, বেয়নটের খোঁচায় ক্ষতবিক্ষত, পোষাক-পরিচ্ছদ ছিন্নভিন্ন, পা হইতে মাথা পর্যন্ত রক্তরঞ্জিত। তাহাদের কিন্তু সে দিকে ভ্রূক্ষেপও নাই। উদ্দাম বিজয়োন্মাদনার নেশায় মৃত্যু-কাতর রণক্লান্তি ভুলিয়া গিয়া তাহারা যেন খেপিয়া উঠিয়াছে। ভাঙা সঙ্গীনের আগায় রক্ত-ফেজ উড়াইয়া ভাঙা-খাটিয়া-আদি-দ্বারা-নির্মিত এক অভিনব চৌদলে কামালকে বসাইয়া বিষম হল্লা করিতে করিতে তাহারা মার্চ করিতেছে। ভূমিকম্পের সময় সাগর কল্লোলের মতো তাহাদের বিপুল বিজয়ধ্বনি আকাশে-বাতাসে যেন কেমন একটা ভীতি-কম্পনের সৃজন করিতেছে। বহু দূর হইতে সে রণ-তাণ্ডব নৃত্যের ও প্রবল ভেরী-তূরীর ঘন রোল শোনা যাইতেছে। অত্যধিক আনন্দে অনেকেরই ঘন ঘন রোমাঞ্চ হইতেছিল। অনেকেরই চোখ দিয়া অশ্রু গড়াইয়া পড়িতেছিল।]
[সৈন্য-বাহিনী দাঁড়াইয়া। হাবিলদার-মেজর তাহাদের মার্চ করাইবার জন্য প্রস্তুত হইতেছিল। বিজয়োন্মত্ত সৈন্যগণ গাইতেছিল,–]
ঐ খেপেছে পাগ্‌লি মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই,
অসুর-পুরে শোর উঠেছে জোর্‌সে সামাল সামাল তাই।
কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই!
হো হো   কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই!
[হাবিলদার-মাজর মার্চের হুকুম করিল,-কুইক্ মার্চ!]
লেফ্‌ট! রাইট! লেফ্‌ট!!
লেফ্‌ট! রাইট! লেফ্‌ট!!
[সৈন্যগণ গাহিতে গাহিতে মার্চ করিতে লাগিল]
ঐ খেপেছে পাগ্‌লি মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই,
অসুর-পুরে শোর উঠেছে জোর্‌সে সামাল সামাল তাই!
কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই!
হো হো    কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই!
[হাবিলদার-মেজর;- লেফ্‌ট্! রাইট!]
সাব্বাস্ ভাই! সাব্বাস্ দিই, সাব্বাস্ তোর শম্‌শেরে।
পাঠিয়ে দিলি দুশ্‌মনে সব যম-ঘর একদম্‌-সে রে!
বল্‌ দেখি ভাই বল্ হাঁ রে,
দুনিয়ার কে ডর্ করে না তুর্কির তেজ তলোয়ারে?
[লেফট্! রাইট! লেফ্‌ট্!]
খুব কিয়া ভাই খুব কিয়া!
বুজ্‌দিল্ ঐ দুশ্‌মন্ সব বিল্‌কুল্ সাফ হো গিয়া!
খুব কিয়া ভাই খুব কিয়া!
হুর্‌রো হো!
হুর্‌রো হো!
দস্যুগুলোয় সাম্‌লাতে যে এমনি দামাল কামাল চাই!
কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই!
হো হো  কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই!
[হাবিলদার-মেজর;- সাবাস সিপাই! লেফ্‌ট্! রাইট্! লেফ্‌ট!]
শির হতে এই পাঁও-তক্ ভাই লাল-লালে-লাল খুন মেখে
রণ-ভিতুদের শান্তি-বাণী শুন্‌বে কে?
পিণ্ডারিদের খুন-রঙিন
নোখ-ভাঙা এই নীল সঙিন
তৈয়ার হেয়্ হর্দম ভাই ফাড়্‌তে যিগর্ শত্রুদের!
হিংসুক-দল! জোর তুলেছি শোধ্ তাদের!
সাবাস্ জোয়ান! সাবাস্!
ক্ষীণজীবি ঐ জীবগুলোকে পায়ের তলেই দাবাস্–
এম্‌নি করে রে–
এমনি জোরে রে–
ক্ষীণজীবি ঐ জীবগুলোকে পায়ের তলেই দাবাস্!–
ঐ চেয়ে দ্যাখ্ আসমানে আজ রক্ত-রবির আভাস!–
সাবাস্ জোয়ান! সাবাস্!!
[লেফট্! রাইট! লেফ্‌ট্]
হিংসুটে ঐ জীবগুলো ভাই নাম ডুবালে সৈনিকের,
তাই তারা আজ নেস্ত-নাবুদ, আমরা মোটেই হইনি জের !
পরের মুলুক লুট করে খায় ডাকাত তারা ডাকাত !
তাই   তাদের তারে বরাদ্দ ভাই আঘাত শুধু আঘাত !
কি বলো ভাই শ্যাঙাত?
হুর্‌রো হো !
হুর্‌রো হো ! !
দনুজ দলে দল্‌তে দাদা এম্‌নি দামাল কামাল চাই !
কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই!
হো হো       কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই!
[হাবিলদার মেজর: রাইট্ হুইল্! লেফ‌্ট্ রাইট্! লেফ্‌ট্! সৈন্যগণ ডানদিকে মোড় ফিরিল।]
আজাদ মানুষ বন্দী করে, অধীন করে স্বাধীন দেশ,
কুল্ মুলুকের কুষ্টি করে জোর দেখালে ক’দিন বেশ,
মোদের হাতে তুর্কি-নাচন নাচ্‌লে তাধিন্ তাধিন্ শেষ!
হুর্‌রো হো!
হুর্‌রো হো!
বদ্‌-নসিবের বরাত খারাব বরাদ্দ তাই কর্‌লে কি না আল্লায়,
পিশাচগুলো পড়্‌ল এসে পেল্লায় এই পাগলাদেরই পাল্লায়!
এই    পাগলাদেরই পাল্লায়!!
হুর্‌রো হো!
হুর্‌রো–
ওদের     কল্লা দেখে আল্লা ডরায়, হল্লা শুধু হল্লা,
ওদের    হল্লা শুধু হল্লা,
এক মুর্গির জোর গায়ে নেই, ধর্‌তে আসেন তুর্কি-তাজি
মর্দ গাজি মোল্লা!
হাঃ! হাঃ! হাঃ!
হেসে   নাড়িই ছেড়ে বা!
হা হা   হাঃ! হাঃ! হাঃ!
[হাবিলদার-মেজর-সাবাস সিপাই! লেফ্‌ট্ রাইট্! লেফ্‌ট্!
সাবাস সিপাই! ফের বল ভাই!]
ঐ খেপেছে পাগলি মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই!
অসুর-পুরে শোর উঠেছে জোর্‌সে সামাল সামাল তাই!
কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই!
হো হো  কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই!
[হাবিলদার-মেজর;- লেফ্‌ট্ হুইল্! য়্যাজ্‌ য়ু ওয়্যার্!- রাইট হুইল!–  লেফ্‌ট্! রাইট! লেফট্‌!]
[সৈন্যদের আঁখির সামনে অস্ত-রবির আশ্চর্য রঙের খেলা ভাসিয়া উঠিল।]
দেখ্‌চ কি দোস্ত অমন করে? হৌ হৌ হৌ!
সত্যি তো ভাই!– সন্ধেটা আজ দেখতে যেন সৈনিকেরই বৌ!
শহীদ সেনার টুক্‌টুকে বৌ লাল-পিরাহান-পরা,
স্বামীর খুনের ছোপ-দেওয়া, তায় ডগডগে আন্‌কোরা!–
না না না,–কল্‌জে যেন টুকরো-করে-কাটা
হাজার তরুণ শহীদ বীরের,–শিউরে উঠে গা’টা!
আস্‌মানের ঐ সিং-দরজায় টাঙিয়েছে কোন্ কসাই!
দেখতে পেলে এক্ষুনি গে এই ছোরাটা কল্‌জেতে তার বসাই!
মুণ্ডুটা তার খসাই!
গোস্বাতে আর পাইনে ভেবে কি যে করি দশাই!
[হাবিলদার-মেজর-সাবাস সিপাই! লেফ্‌ট্! রাইট্! লেফ্‌ট্!]
[ঢালু পার্বত্য পথ, সৈন্যগণ বুকের পিঠের নিহত ও আহত সৈন্যদের ধরিয়া সন্তর্পণে নামিল।]
আহা কচি ভাইরা আমার রে!
এমন কাঁচা জানগুলো খান্‌ খান্‌ করেছে কোন্‌ সে চামার রে?
আহা কচি ভাইরা আমার রে! !
[সাম্‌নে উপত্যকা। হাবিলদার মেজর :– লেফ্‌ট্ ফর্ম! সৈন্য- বাহিনীর মুখ হঠাৎ বামদিকে ফিরিয়া গেল! হাবিলদার মেজর :-ফর্‌ওয়ার্ড ! লেফ্‌ট্ ! রাইট্ ! লেফ্‌ট্ !]
আস্‌মানের ঐ আঙরাখা
খুন-খারাবির রঙ মাখা
কি খুবসুরৎ বাঃ রে বা !
জোর বাজা ভাই কাহারবা!
হোক্ না ভাই এ কারবালা ময়দান–
আমরা যে গাই সাচ্চারই জয়-গান !
হোক্ না এ তোর কার্‌বালা ময়দান ! !
হুর্‌রো হো !
হুর্‌রো–
[সাম্‌নে উপত্যকা– হঠাৎ যেন পথ হারাইয়া ফেলিয়াছে। হাবিলদার-মেজর পথ খুঁজিতে লাগিল। হুকুম দিয়া গেল– ‘মার্ক্ টাইম্।’ সৈন্যরা এক স্থানেই দাঁড়াইয়া পা আছড়াইতে লাগিল–]
দ্রাম্‌! দ্রাম্‍! দ্রাম!
লেফ্‌ট্! রাইট! লেফ্‌ট!
দ্রাম্‌! দ্রাম্! দ্রাম্!
আস্‌মানে ঐ ভাস্‌মান যে মস্ত দুটো রঙের তাল,
একটা নিবিড় নীল-সিয়া আর একটা খুবই গভীর লাল,–
বুঝ্‌লে ভাই! ঐ নীল সিয়াটা শত্রুদের!
দেখ্‌তে নারে কারুর ভালো,
তাইতে কালো রক্ত-ধারার বইছে শিরায় স্রোত ওদের।
হিংস্র ওরা হিংস্র পশুর দল!
গৃধ্নু ওরা, লুব্ধ ওদের লক্ষ্য অসুর বল–
হিংস্র ওরা হিংস্র পশুর দল!
জালিম ওরা অত্যাচারী!
সার জেনেছে সত্য যাহা হত্যা তারই!
জালিম ওরা অত্যাচারী!
সৈনিকের এই গৈরিকে ভাই–
জোর অপমান করলে ওরাই,
তাই তো ওদের মুখ কালো আজ, খুন যেন নীল জল!–
ওরা    হিংস্র পশুর দল!
ওরা    হিংস্র পশুর দল!!
[হাবিলদার-মেজর পথ খুঁজিয়া ফিরিয়া অর্ডার দিল-ফর্‌ওয়ার্ড! লেফ্‌ট্ হুইল্–
সৈন্যগণ আবার চলিতে লাগিল-লেফ্‌ট্ রাইট্! লেফ্‌ট্!]
সাচ্চা ছিল সৈন্য যারা শহীদ হলো মরে।
তোদের মতন পিঠ ফেরেনি প্রাণটা হাতে করে,–
ওরা     শহীদ হলো মরে!
পিট্‌নি খেয়ে পিঠ যে তোদের ঢিট হয়েছে! কেমন!
পৃষ্ঠে তোদের বর্শা বেঁধা, বীর সে তোরা এমন!
মুর্দারা সব যুদ্ধে আসিস্‌! যা যা!
খুন দেখেছিস্ বীরের? হা দেখ্ টক্‌টকে লাল কেমন গরম তাজা!
মুর্দারা সব যা যা!!
[বলিয়াই কটিদেশ হইতে ছোরা খুলিয়া হাতের রক্ত লইয়া দেখাইল]
ত্রঁরাই বলেন হবেন রাজা!
আরে যা যা! উচিত সাজা
তাই দিয়েছে শক্ত ছেলে কামাল ভাই!
[হাবিলদার মেজর;- সাবাস সিপাই!]
এই তো চাই! এই তো চাই!
থাক্‌লে স্বাধীন সবাই আছি, নেই তো নাই, নেই তো নাই!
এই তো চাই!!
[কতকগুলি লোক অশ্রুপূর্ণ নয়নে এই দৃশ্য দেখিবার জন্য ছুটিয়া আসিতেছিল।
তাহাদের দেখিয়া সৈন্যগণ আরও উত্তেজিত হইয়া উঠিল।]
মার্ দিয়া ভাই মার্ দিয়া!
দুশ্‌মন্ সব হার্ গিয়া!
কিল্লা ফতে হো দিয়া।
পর্‌ওয়া নেহি, যা নে দো ভাই যো গিয়া!
কিল্লা ফতে হো গিয়া!
হুর্‌রো হো!
হুর্‌রো হো!
[হাবিলদার-মেজর;-সাবাস জোয়ান! লেফ্‌ট্! রাইট্!]
জোর্‌সে চলো পা মিলিয়ে,
গা হিলিয়ে,
এম্‌নি করে হাত দুলিয়ে!
দাদ্‌রা তালে ‘এক দুই তিন’ পা মিলিয়ে
ঢেউএর মত যাই!
আজ   স্বাধীন এ দেশ! আজাদ মোরা বেহেশ্‌তও না চাই!
আর          বেহেশ্‌তও না চাই!!
[হাবিলদার-মেজর:- সাবাস সিপাই! ফের বল ভাই!]
ঐ খেপেছে পাগলি মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই,
অসুর-পুরে শোর উঠেছে জোর্‌সে সামাল তাই!
কামাল ! তু নে কামাল কিয়া ভাই !
হো হো    কামাল ! তু নে কামাল কিয়া ভাই ! !
[সৈন্যদল এক নগরের পার্শ্ব দিয়া চলিতে লাগিল। নগর-বাসিনীরা ঝরকা হইতে মুখ বাড়াইয়া এই মহান দৃশ্য দেখিতেছিল; তাহদের চোখ-মুখ আনন্দাশ্রুতে আপ্লুত। আজ বধূর মুখের বোরকা খসিয়া পড়িয়াছে। ফুল ছড়াইয়া হাত দুলাইয়া তাহারা বিজয়ী বীরদের অভ্যর্থনা করিতেছিল। সৈন্যগণ চীৎকার করিয়া উঠিল।]
ঐ শুনেছিস্‌? ঝর্‌কাতে সব বল্‌ছে ডেকে বৌ-দলে,
‘কে বীর তুমি? কে চলেছ চৌদলে?’
চিনিস্‌নে কি? এমন বোকা বোনগুলি সব!– কামাল এ যে কামাল!
পাগলি মায়ের দামাল ছেলে! ভাই যে তোদের!
তা না হলে কার হবে আর রৌশন্ এমন জামাল?
কামাল এ যে কামাল!!
উড়িয়ে দেবো পুড়িয়ে দেবো ঘর-বাড়ি সব সামাল!
ঘর-বাড়ি সব সামাল!!
আজ আমাদের খুন ছুটেছে, হোশ টুটেছে,
ডগ্‌মগিয়ে জোশ উঠেছে!
সাম্‌নে থেকে পালাও!
শোহরত দাও নওরাতি আজ! হর্‌ ঘরে দীপ জ্বালাও!
সাম্‌নে থেকে পালাও!
যাও ঘরে দীপ জ্বালাও!!
[হাবিলদার-মেজর:- লেফ্‌ট্ ফর্ম্! লেফ্‌ট্! রাইট! লেফ্‌ট্!-ফরওয়ার্ড্!]
[বাহিনীর মুখ হঠাৎ বামদিকে ফিরিয়া গেল। পার্শ্বেই পরিখার সারি। পরিখা-ভর্তি নিহত সৈন্যের দল পচিতেছে এবং কতকগুলি অ-সামরিক নগরবাসী তাহা ডিঙাইয়া ডিঙাইয়া চলিতেছে।]
ইস্! দেখেছিস! ঐ কারা ভাই সাম্‌লে চলেন পা,
ফস্‌কে মরা আধ-মরাদের মাড়িয়ে ফেলেন বা!
ও তাই শিউরে ওঠে গা!
হাঃ হাঃ হাঃ!
মরল যে সে মরেই গেছে,
বাঁচ্‌ল যারা রইল বেঁচে!
এই তো জানি সোজা হিসাব! দুঃখ কি তার আঁ?
মরায় দেখে ডরায় এরা! ভয় কি মরায়? বাঃ!
হাঃ হাঃ হাঃ!
[সম্মুখে সঙ্কীর্ণ ভগ্ন সেতু। হাবিলদার-মেজর অর্ডার দিল-‘ফর্ম্ ইন্‌টু সিঙ্গল্‌ লাইন’। এক একজন করিয়া বুকের পিঠের নিহত ও আহত ভাইদের চাপিয়া ধরিয়া অতি সন্তর্পণে ‘স্লো মার্চ’ করিয়া পার হইতে লাগিল।]
সত্যি কিন্তু ভাই!
যখন মোদের বক্ষে-বাঁধা ভাইগুলির এই মুখের পানে চাই–
কেমন সে এক ব্যথায় তখন প্রাণটা কাঁদে যে সে!
কে যেন দুই বজ্র-হাতে চেপে ধরে কল্‌জেখানা পেষে!
নিজের হাজার ঘায়েল জখম ভুলে তখন ডুক্‌রে কেন কেঁদেও ফেলি শেষে!
কে যেন ভাই কল্‌জেখানা পেষে!!
ঘুমোও পিঠে, ঘুমোও বুকে, ভাইটি আমার, আহা!
বুক যে ভরে হাহাকারে যতই তোরে সাব্বাস দিই,
যতই বলি বাহা!
লক্ষ্মীমণি ভাইটি আমার, আহা!!
ঘুমোও ঘুমোও মরণ-পরের ভাইটি আমার, আহা!!
অস্ত-পারের দেশ পারায়ে বহুৎ সে দূর তোদের ঘরের রাহা!
ঘুমোও এখন ঘুমোও ঘুমোও ভাইটি ছোট আহা!
মরণ-বধূর লাল রাঙা বর! ঘুমো!
আহা, এমন চাঁদমুখে তোর কেউ দিল না চুমো!হতভাগা রে!
মরেও যে তুই দিয়ে গেলি বহুৎ দাগা রে
না জানি কোন্ ফুট্‌তে-চাওয়া মানুষ-কুঁড়ির হিয়ায়!
তরুণ জীবন এম্‌নি গেল, একটি রাতও পেলিনে রে বুকে কোনো প্রিয়ায়!
অরুণ খুনের তরুণ শহীদ! হতভাগ্য রে!
মরেও যে তুই দিয়ে গেলি বহুৎ দাগা রে!
তাই যত আজ লিখ্‌নে-ওয়ালা তোদের মরণ ফুর্তি-সে জোর লেখে!
এক লাইনে দশ হাজারের মৃত্যু-কথা! হাসি রকম দেখে‍!
মরলে কুকুর ওদের, ওরা শহীদ-গাথার বই লেখে!
খবর বেরোয় দৈনিকে,
আর   একটি কথায় দুঃখ জানান, ‘জোর মরেছে দশটা হাজার সৈনিকে!’
আঁখির পাতা ভিজল কি না কোনো কালো চোখের,
জান্‌ল না হায় এ-জীবনে ঐ সে তরুণ দশটি হাজার লোকের!
পচে মরিস পরিখাতে, মা-বোনেরাও শুনে বলে ‘বাহা’!
সৈনিকেরই সত্যিকারের ব্যথার ব্যথী কেউ কি রে নেই? আহা!–
আয় ভাই তোর বৌ এল ঐ সন্ধ্যা মেয়ে রক্ত-চেলি পরে,
আঁধার-শাড়ি পরবে এখন পশ্‌বে যে তোর গোরের বাসর-ঘরে!–
ভাবতে নারি, গোরের মাটি করবে মাটি এ মুখ কেমন করে–
সোনা মানিক ভাইটি আমার ওরে!
বিদায়-বেলায় আরেকটিবার দিয়ে যা ভাই চুমো!
অনাদরের ভাইটি আমার! মাটির মায়ের কোলে এবার ঘুমো!!
[নিহত সৈন্যদের নামাইয়া রাখিয়া দিয়া সেতু পার হইয়া আবার জোরে মার্চ করিতে করিতে তাহাদের রক্ত গরম হইয়া উঠিল।]
ঠিক বলেছ দোস্ত তুমি!
চোস্ত কথা! আয় দেখি–তোর হস্ত চুমি!
মৃত্যু এরা জয় করেছে, কান্না কিসের?
আব্-জম্-জম্ আনলে এরা, আপনি পিয়ে কল্‌সি বিষের!
কে মরেছে? কান্না কিসের?
বেশ করেছে!
দেশ বাঁচাতে আপ্‌নারি জান শেষ করেছে!
বেশ করেছে!!
শহীদ ওরাই শহীদ!
বীরের মতন প্রাণ দিয়েছে খুন ওদেরি লোহিত!
শহীদ ওরাই শহীদ!!
[এইবার তাহাদের তাম্বু দেখা গেল। মহাবীর আনোয়ার পাশা বহু সৈন্যসামন্ত ও সৈনিকদের আত্মীয়-স্বজন লইয়া বিজয়ী বীরদের অভ্যর্থনা করিতে আসিতেছেন দেখিয়া সৈন্যগণ আনন্দে আত্মহারা হইয়া ‘ডবল মার্চ’ করিতে লাগিল]
হুর্‌রো হো!
হু‌র্‌রো হো!!
ভাই-বেরাদর পালাও এখন! দূর্ রহো! দূর্ রহো!!
হুর্‌রো হো! হুর্‌রো হো!
[কামাল পাশাকে কোলে করিয়া নাচিতে লাগিল]
হৌ হৌ হৌ! কামাল জিতা রও!
কামাল জিতা রও!
ও কে আসে? আনোয়ার ভাই?–
আনোয়ার ভাই! জানোয়ার সব সাফ!!
জোর নাচো ভাই! হর্দম্ দাও লাফ!
আজ জানোয়ার সব সাফ!
হুর্‌রো হো! হুর্‌রো হো!!
সব-কুছ আব্ দূর্ রহো! – হুর্‌রো হো! হুর্‌রো হো!!
রণ জিতে জোর মন মেতেছে!-সালাম সবায় সালাম!–
নাচ্‌না থামা রে!
জখ্‌মি ঘায়েল ভাইকে আগে আস্তে নামা রে!
নাচ্‌না থামা রে!–
[আহতদেরে নামাইতে নামাইতে]
কে ভাই? হাঁ হাঁ, সালাম!
–ঐ শোন্‌ শোন্‌ সিপাহ্‌-সালার কামাল ভাই-এর কামাল।
[সেনাপতির অর্ডার আসিল]
‘সাবাস! থামো! হো! হো!
সাবাস! হল্ট্! এক! দো!’
[এক নিমিষে সমস্ত কল-রোল নিস্তব্ধ হইয়া গেল। তখনো কি তারায় তারায় যেন ঐ বিজয় গীতির হারা-সুর বাজিয়া বাজিয়া ক্রমে ক্ষীণ হইতে ক্ষীণ হইয়া মিলিয়া গেল–]
ঐ খেপেছে পাগলি মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই!
অসুর-পুরে শোর উঠেছে জোরসে সামাল সামাল তাই!
কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই।
হো হো,     কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই!!

-: শব্দার্থ :-
তু নে– তুমি। কামাল কিয়া– অভাবনীয় কাণ্ড করলে, অসম্ভব করলে! [‘কামাল মানে কিন্তু পূর্ণ’] শমশেরে– তরবারিকে। বিল্‌কুল সাফ হো গিয়া– একদম পরিষ্কার হয়ে গেছে। খুব কিয়া–আচ্ছা করেছ। বুজদিল–ভীরু, কাপুরুষ। পাঁও তক– পা পর্যন্ত। নেস্ত-নাবুদ– ধ্বংস-বিধ্বংস; কুল মুলুক– সমস্ত দেশ। আজাদ– মুক্ত; বদ্-নসিব–  দুর্ভাগ্য; ত্যজি–  যুদ্ধাশ্ব; পিরাহান– পিরান। গোস্বা– ক্রোধ; খুবসরৎ–  সুন্দর; সিয়া– কৃষ্ণবর্ণ। জালিম– উৎপীড়ক; মুর্দা–  মৃত; জামাল– রূপ। জোশ– উত্তেজনা; শোহরত–  ঘোষণা; নোরাতি– উৎসব-রাত্রি; ভাই-বেরাদর– আত্মীয়-স্বজন। জিতা রও– বেঁচে থাক; আব্–  এখন; জখ্‌মি – ঘায়েল, আহত। সিপাহি-সালার – প্রধান সেনাপতি; কালাম– হুকুম।

ধুমকেতু

আমি     যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুন মহাবিপ্লব হেতু
         এই     স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু!
সাত      সাতশো নরক-জ্বালা জলে মম ললাটে,
মম       ধূম-কুণ্ডুলি করেছে শিবের ত্রিনয়ন ঘর ঘোলাটে!
আমি     অশিব তিক্ত অভিশাপ,
আমি     স্রষ্টার বুকে সৃষ্টি-পাপের অনুতাপ-তাপ-হাহাকার–
           আর    মর্তে সাহারা-গোবি-ছাপ,
           আমি   অশিব তিক্ত অভিশাপ!

আমি     সর্বনাশের ঝাণ্ডা উড়ায়ে বোঁও বোঁও ঘুরি শূন্যে,
আমি     বিষ-ধূম-বাণ হানি একা ঘিরে ভগবান-অভিমুন্যে।
           শোঁও    শন-নন-নন-শন-নন-নন শাঁই শাঁই,
           ঘুর্       পাক্ খাই, ধাই পাঁই পাঁই
           মম       পুচ্ছে জড়ায়ে সৃষ্টি;
           করি      উল্কা-অশনি-বৃষ্টি,–
আমি   একটা বিশ্ব গ্রাসিয়াছি, পারি গ্রাসিতে এখনো ত্রিশটি।
আমি   অপঘাত দুর্দৈব রে আমি সৃষ্টির অনাসৃষ্টি!

আমি   আপনার বিষ-জ্বালা-মদ-পিয়া মোচড় খাইয়া খাইয়া
জোর   বুঁদ হয়ে আমি চলেছি ধাইয়া ভাইয়া!
শুনি    মম বিষাক্ত 'রিরিরিরি'-নাদ
         শোনায় দ্বিরেফ-গুঞ্জন সম বিশ্ব-ঘোরার প্রণব-নিনাদ!
         ধূর্জটি-শিখ করাল পুচ্ছে
         দশ অবতারে বেঁধে ঝ্যাঁটা করে ঘুরাই উচ্চে, ঘুরাই–
আমি   অগ্নি-কেতন উড়াই!–
আমি   যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুন মহাবিপ্লব হেতু
এই    স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু!

ঐ     বামন বিধি সে আমারে ধরিতে বাড়ায়েছিল রে হাত
মম    অগ্নি-দাহনে জ্বলে পুড়ে তাই ঠুঁটো সে জগন্নাথ!
আমি   জানি জানি ঐ স্রষ্টার ফাঁকি, সৃষ্টির ঐ চাতুরী,
তাই   বিধি ও নিয়মে লাথি মেরে, ঠুকি বিধাতার বুকে হাতুড়ি।
আমি   জানি জানি ঐ ভুয়ো ঈশ্বর দিয়ে যা হয়নি হবে তাও!
তাই   বিপ্লব আনি বিদ্রোহ করি, নেচে নেচে দিই গোঁফে তাও!
তোর   নিযুত নরকে ফুঁ দিয়ে নিবাই, মৃত্যুর মুখে থুথু দি!
আর   যে যত রাগে রে তারে তত কাল্-আগুনের কাতুকুতু দি।
মম    তূরীয় লোকের তির্যক্ গতি তূর্য গাজন বাজায়
মম    বিষ নিশ্বাসে মারীভয় হানে অরাজক যত রাজায়!

কচি   শিশু-রসনায় ধানি-লঙ্কার পোড়া ঝাল
আর   বন্ধ কারায় গন্ধক ধোঁয়া, এসিড, পটাশ, মোন্‌ছাল,
আর   কাঁচা কলিজায় পচা ঘা'র সম সৃষ্টিরে আমি দাহ করি
                      আর স্রষ্টারে আমি চুষে খাই!
পেলে   বাহান্ন-শও জাহান্নমেও আধা চুমুকে সে শুষে যাই!

আমি   যুগে যুগে আসি আসিয়াছি পুন মহাবিপ্লব হেতু–
এই     স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু!
আমি   শি শি শি প্রলয়-শিশ্ দিয়ে ঘুরি কৃতঘ্নী ঐ বিশ্বমাতার শোকাগ্নি,
আমি   ত্রিভুবন তার পোড়ায়ে মারিয়া আমিই করিব মুখাগ্নি!
তাই আমি ঘোর তিক্ত সুখে রে, একপাক ঘুরে বোঁও করে ফের দু'পাক নি!
         কৃতঘ্নী আমি কৃতঘ্নী ঐ বিশ্বমাতার শোকাগ্নি!

         পঞ্জর মম খর্পরে জ্বলে নিদারুণ যেই বৈশ্বানর–
                  শোন্ রে মর, শোন্ অমর!–
                  সে যে তোদের ঐ বিশ্বপিতার চিতা!
        এ চিতাগ্নিতে জগদীশ্বর পুড়ে ছাই হবে, হে সৃষ্টি জানো কি তা?
        কি বলো? কি বলো? ফের বলো ভাই আমি শয়তান-মিতা!
হো হো  ভগবানে আমি পোড়াব বলিয়া জ্বালায়েছি বুকে চিতা!
ছোট   শন শন শন ঘর ঘর সাঁই সাঁই!
ছোট         পাঁই পাঁই!
তুই    অভিশাপ তুই শয়তান তোর অনন্তকাল পরমাই!
ওরে   ভয় নাই তোর মার নাই!!
তুই    প্রলয়ঙ্কর ধূমকেতু,
তুই    উগ্র ক্ষিপ্ত তেজ-মরীচিকা ন'স্ অমরার ঘুম-সেতু
                    তুই     ভৈরব ভয় ধূমকেতু!
আমি    যুগে যুগে আসি আসিয়াছি পুন মহাবিপ্লব হেতু
এই      স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু !

ঐ       ঈশ্বর-শির উল্লজ্ঘিতে আমি আগুনের সিঁড়ি,
আমি   বসিব বলিয়া পেতেছে ভবানী ব্রহ্মার বুকে পিঁড়ি !
খ্যাপা  মহেশের বিক্ষিপ্ত পিনাক, দেবরাজ-দম্ভোলি
লোকে  বলে মোরে, শুনে হাসি আমি আর নাচি বব-বম্ বলি !
এই    শিখায় আমার নিযুত ত্রিশূল বাশুলি বজ্র-ছড়ি
ওরে   ছড়ানো রয়েছে, কত যায় গড়াগড়ি !
মহা    সিংহাসনে সে কাঁপিছে বিশ্ব-সম্রাট নিরবধি,
তার    ললাট তপ্ত অভিশাপ-ছাপ এঁকে দিই আমি যদি !
তাই   টিটকিরি দিয়ে হাহা হেসে উঠি,

আমি   বাজাই আকাশে তালি দিয়া 'তাতা-উর্-তাক্'
আর   সোঁও সোঁও করে প্যাঁচ দিয়ে খাই চিলে-ঘুড়ি সম ঘুরপাক!
মম    নিশাস আভাসে অগ্নি-গিরির বুক ফেটে ওঠে ঘুৎকার
আর   পুচ্ছে আমার কোটি নাগ-শিশু উদ্গারে বিষ-ফুৎকার!

কাল            বাঘিনী যেমন ধরিয়া শিকার
                 তখনি রক্ত শোষে না রে তার,
          দৃষ্টি-সীমায় রাখিয়া তাহারে উগ্রচণ্ড-সুখে
          পুচ্ছ সাপটি খেলা করে আর শিকার মরে সে ধুঁকে!
                 তেমনি করিয়া ভগবানে আমি
                 দৃষ্টি-সীমায় রাখি দিবাযামী
ঘিরিয়া  ঘিরিয়া খেলিতেছি খেলা, হাসি পিশাচের হাসি
         এই অগ্নি-বাঘিনী আমি যে সর্বনাশী!

আজ   রক্ত-মাতাল উল্লাসে মাতি রে–
মম    পুচ্ছে ঠিকরে দশগুণ ভাতি,
         রক্ত রুদ্র উল্লাসে মাতি রে!
ভগবান? সে তো হাতের শিকার!– মুখে ফেনা উঠে মরে!
ভয়ে   কাঁপিছে, কখন পড়ি গিয়া তার আহত বুকের 'পরে!
        অথবা যেন রে অসহায় এক শিশুরে ঘিরিয়া

অজগর কাল-কেউটে সে কোন ফিরিয়া ফিরিয়া
চায়, আর ঘোরে শন্‌ শন্ শন্,
ভয়-বিহ্বল শিশু তার মাঝে কাঁপে রে যেমন–
      তেমনি করিয়া ভগবানে ঘিরে
ধূমকেতু-কালনাগ অভিশাপ ছুটে চলেছি রে,
      আর সাপে-ঘেরা অসহায় শিশু সম
বিধাতা তাদের কাঁপিছে রুদ্র ঘূর্ণির মাঝে মম!

আজিও ব্যথিত সৃষ্টির বুকে ভগবান কাঁদে ত্রাসে,
স্রষ্টার চেয়ে সৃষ্টি পাছে বা বড় হয়ে তারে গ্রাসে!

আগমনী

একি    রণ-বাজা বাজে ঘন ঘন–
ঝন    রনরন রন ঝনঝন!
সেকি   দমকি দমকি
           ধমকি ধমকি
      দামা-দ্রিমি-দ্রিমি গমকি গমকি
      ওঠে চোটে চোটে,
      ছোটে লোটে ফোটে
      বহ্নি-ফিনিকি        চমকি চমকি
      ঢাল-তলোয়ারে খনখন!
একি       রণ-বাজা বাজে ঘন ঘন
রণ         ঝনঝন ঝন রণরণ!
হৈ          হৈ রব
ঐ          ভৈরব
হাঁকে,     লাখে লাখে
ঝাঁকে     ঝাঁকে ঝাঁকে
লাল       গৈরিক-গায় সৈনিক ধায় তালে তালে
ওই         পালে পালে,
ধরা কাঁপে দাপে।
জাঁকে       মহাকাল কাঁপে থরথর!
রণে        কড়কড় কাড়া-খাঁড়া-ঘাত,
শির        পিষে হাঁকে রথ-ঘর্ঘর-ধ্বনি ঘররর!
‘গুরু      গরগর’ বোলে ভেরী তূরী,
‘হর        হর হর’
করি       চীৎকার ছোটে সুরাসুর-সেনা হনহন!
ওঠে        ঝন্‌ঝা ঝাপটি দাপটি সাপটি
হু-হু-হু-হু-হু-হু-শনশন!
ছোটে       সুরাসুর-সেনা হনহন!
তাতা      থৈথৈ তাতা থৈথৈ খল খল খল
নাচে        রণ-রঙ্গিণী সঙ্গিনী সাথে,
ধকধক জ্বলে জ্বলজ্বল
বুকে        মুখে চোখে রোষ-হুতাশন!
রোস্ কোথা শোন্!
ঐ        ডম্বরু-ঢোলে ডিমিডিমি বোলে,
ব্যোম মরুৎ স-অম্বর দোলে,
মম-বরুণ কী কল-কল্লোলে চলে উতরোলে
ধ্বংসে মাতিয়া            তাথিয়া তাথিয়া
নাচিয়া রঙ্গে! চরণ-ভঙ্গে
সৃষ্টি সে টলে টলমল!
ওকি         বিজয়-ধ্বনি সিন্ধু গরজে কলকল কল কলকল!
ওঠে           কোলাহল,
কূট            হলাহল
ছোটে         মন্থনে পুন রক্ত-উদধি,
ফেনা-বিষ ক্ষরে গলগল!
টলে          নির্বিকার সে বিধাত্রীরো গো
সিংহ-আসন টলমল!
কার         আকাশ-জোড়া ও আনত-নয়ানে
করুণা-অশ্রু ছলছল!
বাজে         মৃত সুরাসুর-পাঁজরে ঝাঁজর ঝম্‌ঝম,
নাচে         ধূর্জটি সাথে প্রমথ ববম্ বম্‌বম্!
লাল          লালে-লাল ওড়ে ঈশানে নিশান যুদ্ধের,
ওঠে          ওঙ্কার রণ-ডঙ্কার,
নাদে         ওম্ ওম্ মহাশঙ্খ বিষাণ রুদ্রের!
ছোটে         রক্ত-ফোয়ারা বহ্নির বান রে!
কোটি        বীর-প্রাণ
ক্ষণে          নির্বাণ
তবু          শত সূর্যের জ্বালাময় রোষ
গমকে শিরায় গম্‌গম্!
ভয়ে         রক্ত-পাগল প্রেত পিশাচেরও
শিরদাঁড়া করে চন্‌চন্!
যত          ডাকিনী যোগিনী বিস্ময়াহতা,
নিশীথিনী ভয়ে থম্‌থম্!
বাজে        মৃত সুরাসুর-পাঁজরে ঝাঁঝর ঝম্‌ঝম্!
ঐ            অসুর-পশুর মিথ্যা দৈত্য-সেনা যত
হত          আহত করে রে দেবতা সত্য!
স্বর্গ, মর্ত, পাতাল, মাতাল রক্ত-সুরায়;
ত্রস্ত বিধাতা,
মস্ত          পাগল পিনাক-পাণি স-ত্রিশূল প্রলয়-হস্ত ঘুরায়!
ক্ষিপ্ত সবাই রক্ত-সুরায়!
চিতার উপরে চিতা সারি সারি,
চারিপাশে তারি
ডাকে কুক্কুর গৃহিনী শৃগাল!
প্রলয়-দোলায় দুলিছে ত্রিকাল!
প্রলয়-দোলায় দুলিছে ত্রিকাল!!
আজ         রণ-রঙ্গিণী জগৎমাতার দেখ্ মহারণ,
দশদিকে তাঁর দশ হাতে বাজে দশ প্রহরণ!
পদতলে লুটে মহিষাসুর,
মহামাতা ঐ সিংস-বাহিনী জানায় আজিকে বিশ্ববাসীকে–
শাশ্বত নহে দানব-শক্তি, পায়ে পিষে যায় শির পশুর!
‌‌’নাই দানব
নাই অসুর,–
চাইনে সুর,
চাই মানব!’–
বরাভয়-বাণী ঐ রে কার
শুনি, নহে হৈ রৈ এবার!
ওঠ্ রে ওঠ্,
ছোট্ রে ছোট্!
শান্ত মন,
ক্ষান্ত রণ!–
খোল্ তোরণ,
চল্ বরণ
করব্ মা’য়;
ডর্‌ব কায়?
ধরব পা’য় কার্ সে আর,
বিশ্ব-মা’ই পার্শ্বে যার?
আজ         আকাশ-ডোবানো নেহারি তাঁহারি চাওয়া,
ঐ             শেফালিকা-তলে কে বালিকা চলে?
কেশের গন্ধ আনিছে আশিন-হাওয়া!
এসেছে রে সাথে উৎপলাক্ষী চপলা কুমারী কমলা ঐ,
সরসিজ-নিভ শুভ্র বালিকা
এল              বীণা-পাণি অমলা ঐ!
এসেছে গনেশ,
এসেছে মহেশ,
বাস্‌রে বাস্!
জোর উছাস্!!
এল সুন্দর সুর-সেনাপতি,
সব মুখ এ যে চেনা-চেনা অতি!
বাস্ রে বাস্‌ জোর উছাস্!!
হিমালয়! জাগো! ওঠো আজি,
তব সীমা লয় হোক।
ভুলে যাও শোক– চোখে জল ব’ক
শান্তির– আজি শান্তি-নিলয় এ আলয় হোক!
ঘরে ঘরে আজি দীপ জ্বলুক!
মা’র আবাহন-গীত্ চলুক!
দীপ জ্বলুক!
গীত চলুক!!
আজ         কাঁপুক মানব-কলকল্লোলে কিশলয় সম নিখিল ব্যোম্!
স্বা-গতম্!
স্বা-গতম্!!
মা-তরম্!
মা-তরম্!!
ঐ ঐ ঐ বিশ্ব কণ্ঠে
বন্দনা- বাণী লুণ্ঠে-‘বন্দে মাতরম্!!!’

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

পারিভাষিক শব্দ

প্রকৃতি ও প্রত্যয় H S C ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য

সমাস H S C ছাত্র -ছাত্রীদের জন্য।