কোড়ি ও কোমল


















এ যেন রে অভিশপ্ত প্রেতের পিপাসা —
সলিল রয়েছে প ‘ ড়ে , শুধু দেহ নাই ।
এ কেবল হৃদয়ের দুর্বল দুরাশা
সাধের বস্তুর মাঝে করে চাই – চাই ।
দুটি চরণেতে বেঁধে ফুলের শৃঙ্খল
কেবল পথের পানে চেয়ে বসে থাকা!
মানবজীবন যেন সকলি নিষ্ফল —
বিশ্ব যেন চিত্রপট , আমি যেন আঁকা !
চিরদিন বুভুক্ষিত প্রাণহুতাশন
আমারে করিছে ছাই প্রতি পলে পলে ,
মহত্ত্বের আশা শুধু ভারের মতন
আমারে ডুবায়ে দেয় জড়ত্বের তলে ।
কোথা সংসারের কাজে জাগ্রত হৃদয়!
কোথা রে সাহস মোর অস্থিমজ্জাময় ! 




পাশ দিয়ে গেল চলি চকিতের প্রায় ,
অঞ্চলের প্রান্তখানি ঠেকে গেল গায় ,
শুধু দেখা গেল তার আধখানি পাশ —
শিহরি পরশি গেল অঞ্চলের বায় ।
অজানা হৃদয়বনে উঠেছে উচ্ছ্বাস ,
অঞ্চলে বহিয়া এল দক্ষিণবাতাস ,
সেথা যে বেজেছে বাঁশি তাই শুনা যায় ,
সেথায় উঠিছে কেঁদে ফুলের সুবাস ।
কার প্রাণখানি হতে করি হায় – হায়
বাতাসে উড়িয়া এল পরশ – আভাস !
ওগো কার তনুখানি হয়েছে উদাস ,
ওগো কে জানাতে চাহে মরম বারতা !
দিয়ে গেল সর্বাঙ্গের আকুল নিশ্বাস ,
বলে গেল সর্বাঙ্গের কানে কানে কথা ।।










আজ কি , তপন , তুমি যাবে অস্তাচলে
না শুনে আমার মুখে একটিও গান !
দাঁড়াও গো , বিদায়ের দুটি কথা বলে
আজিকার দিন আমি করি অবসান ।
থামো ওই সমুদ্রের প্রান্তরেখা -‘ পরে ,
মুখে মোর রাখো তব একমাত্র আঁখি ।
দিবসের শেষ পলে নিমেষের তরে
তুমি চেয়ে থাকো আর আমি চেয়ে থাকি ।
দুজনের আঁখি -‘ পরে সায়াহ্ন – আঁধার
আঁখির পাতার মতো আসুক মুদিয়া ,
গভীর তিমিরস্নিগ্ধ শান্তির পাথার
নিবায়ে ফেলুক আজি দুটি দীপ্ত হিয়া ।
শেষ গান সাঙ্গ করে থেমে গেছে পাখি ,
আমার এ গানখানি ছিল শুধু বাকি ।





সন্ধ্যাসূর্যের প্রতি
আমার এ গান তুমি যাও সাথে করে
নূতন সাগরতীরে দিবসের পানে ।
সায়াহ্নের কূল হতে যদি ঘুমঘোরে
এ গান উষার কূলে পশে কারো কানে!
সারা রাত্রি নিশীথের সাগর বাহিয়া
স্বপনের পরপারে যদি ভেসে যায় ,
প্রভাত – পাখিরা যবি উঠিবে গাহিয়া
আমার এ গান তারা যদি খুঁজে পায় ।
গোধূলির তীরে বসে কেঁদেছে যে জন ,
ফেলেছে আকাশে চেয়ে অশ্রুজল কত ,
তার অশ্রু পড়িবে কি হইয়া নূতন
নবপ্রভাতের মাঝে শিশিরের মতো ।
সায়াহ্নের কুঁড়িগুলি আপনা টুটিয়া
প্রভাতে কি ফুল হয়ে উঠে না ফুটিয়া !






     আজি       শরততপনে প্রভাতস্বপনে 
                   কী জানি পরান কী যে চায় ! 
     ওই        শেফালির শাখে কী বলিয়া ডাকে 
                   বিহগবিহগী কী যে গায় ! 
     আজি       মধুর বাতাসে হৃদয় উদাসে , 
                   রহে না আবাসে মন হায় ! 
     কোন্     কুসুমের আশে , কোন্ ফুলবাসে 
                   সুনীল আকাশে মন ধায় ! 
  
     আজি       কে যেন গো নাই , এ প্রভাতে তাই 
                   জীবন বিফল হয় গো ! 
     তাই       চারি দিকে চায় , মন কেঁদে গায় — 
                    ‘ এ নহে , এ নহে , নয় গো ! ' 
     কোন্     স্বপনের দেশে আছে এলোকেশে 
                    কোন্ ছায়াময়ী অমরায় ! 
     আজি       কোন্ উপবনে বিরহবেদনে 
                   আমারি কারণে কেঁদে যায় ! 
  
     আমি       যদি গাঁথি গান অথির - পরান 
                   সে গান শুনাব কারে আর ! 
     আমি       যদি গাঁথি মালা লয়ে ফুলডালা 
                   কাহারে পরাব ফুলহার ! 
     আমি       আমার এ প্রাণ যদি করি দান 
                   দিব প্রাণ তবে কার পায় ! 
     সদা       ভয় হয় মনে পাছে অযতনে 
                   মনে মনে কেহ ব্যথা পায় ! 






মোছো তবে অশ্রুজল , চাও হাসিমুখে
বিচিত্র এ জগতের সকলের পানে ।
মানে আর অপমানে সুখে আর দুখে
নিখিলের ডেকে লও প্রসন্ন পরানে ।
কেহ ভালোবাসে কেহ নাহি ভালোবাসে ,
কেহ দূরে যায় কেহ কাছে চলে আসে —
আপনার মাঝে গৃহ পেতে চাও যদি
আপনারে ভুলে তবে থাকো নিরবধি ।
ধনীর সন্তান আমি , নহি গো ভিখারি ,
হৃদয়ে লুকানো আছে প্রেমের ভাণ্ডার —
আমি ইচ্ছা করি যদি বিলাইতে পারি
গভীর সুখের উৎস হৃদয় আমার ।
দুয়ারে দুয়ারে ফিরি মাগি অন্নপান
কেন আমি করি তবে আত্ম-অপমান !





আপনি কণ্টক আমি , আপনি জর্জর ।
আপনার মাঝে আমি শুধু ব্যথা পাই ।
সকলের কাছে কেন যাচি গো নির্ভর —
গৃহ নাই , গৃহ নাই , মোর গৃহ নাই !
অতি তীক্ষ্ম অতি ক্ষুদ্র আত্ম – অভিমান
সহিতে পারে না হায় তিল অসম্মান ।
আগেভাগে সকলের পায়ে ফুটে যায়
ক্ষুদ্র ব ‘ লে পাছে কেহ জানিতে না পায় ।
বরঞ্চ আঁধারে রব ধুলায় মলিন ,
চাহি না চাহি না এই দীন অহংকার —
আপন দারিদ্র্যে আমি রহিব বিলীন ,
বেড়াব না চেয়ে চেয়ে প্রসাদ সবার ।
আপনার মাঝে যদি শান্তি পায় মন
বিনীত ধুলার শয্যা সুখের শয়ন ।







পৃথিবী জুড়িয়া বেজেছে বিষাণ , 
    শুনিতে পেয়েছি ওই — 
সবাই এসেছে লইয়া নিশান , 
    কই রে বাঙালি কই ! 
সুগভীর স্বর কাঁদিয়া বেড়ায় 
    বঙ্গসাগরের তীরে , 
‘ বাঙালির ঘরে কে আছিস আয়‘ 
    ডাকিতেছে ফিরে ফিরে । 
ঘরে ঘরে কেন দুয়ার ভেজানো , 
    পথে কেন নাই লোক , 
সারা দেশ ব্যাপি মরেছে কে যেন — 
    বেঁচে আছে শুধু শোক । 
গঙ্গা বহে শুধু আপনার মনে , 
    চেয়ে থাকে হিমগিরি , 
রবি শশী উঠে অনন্ত গগনে 
    আসে যায় ফিরি ফিরি । 
কত - না সংকট , কত - না সন্তাপ 
    মানবশিশুর তরে , 
কত - না বিবাদ কত - না বিলাপ 
    মানবশিশুর ঘরে ! 
কত ভায়ে ভায়ে নাহি যে বিশ্বাস , 
    কেহ কারে নাহি মানে , 
ঈর্ষা নিশাচরী ফেলিছে নিশ্বাস 
    হৃদয়ের মাঝখানে । 
হৃদয়ে লুকানো হৃদয়বেদনা , 
    সংশয় - আঁধারে যুঝে , 
কে কাহারে আজি দিবে গো সান্ত্বনা — 
    কে দিবে আলয় খুঁজে ! 
মিটাতে হইবে শোক তাপ ত্রাস , 
    করিতে হইবে রণ , 
পৃথিবী হইতে উঠেছে উচ্ছ্বাস — 
    শোনো শোনো সৈন্যগণ ! 
পৃথিবী ডাকিছে আপন সন্তানে , 
    বাতাস ছুটেছে তাই — 
গৃহ তেয়াগিয়া ভায়ের সন্ধানে 
     চলিয়াছে কত ভাই । 
বঙ্গের কুটিরে এসেছে বারতা , 
    শুনেছে কি তাহা সবে ? 
জেগেছে কি কবি শুনাতে সে কথা 
    জালদগম্ভীর রবে ? 
হৃদয় কি কারো উঠেছে উথলি ? 
    আঁখি খুলেছে কি কেহ ? 
ভেঙেছে কি কেহ সাধের পুতলি ? 
    ছেড়েছে খেলার গেহ ? 
কেন কানাকানি , কেন রে সংশয় ? 
    কেন মরো ভয়ে লাজে ? 
খুলে ফেলো দ্বার , ভেঙে ফেলো ভয় , 
    চলো পৃথিবীর মাঝে । 
ধরাপ্রান্তভাগে ধুলিতে লুটায়ে , 
    জড়িমাজড়িত তনু , 
আপনার মাঝে আপনি গুটায়ে 
    ঘুমায় কীটের অণু । 
চারি দিকে তার আপন - উল্লাসে 
    জগৎ ধাইছে কাজে , 
চারি দিকে তার অনন্ত আকাশে 
    স্বরগসংগীত বাজে ! 
চারি দিকে তার মানবমহিমা 
    উঠিছে গগনপানে , 
খুঁজিছে মানব আপনার সীমা 
    অসীমের মাঝখানে ! 
সে কিছুই তার করে না বিশ্বাস , 
    আপনারে জানে বড়ো — 
আপনি গণিছে আপন নিশ্বাস , 
    ধুলা করিতেছে জড়ো । 
সুখদুঃখ লয়ে অনন্ত সংগ্রাম , 
    জগতের রঙ্গভূমি — 
হেথায় কে চায় ভীরুর বিশ্রাম , 
    কেন গো ঘুমাও তুমি । 
ডুবিছ ভাসিছ অশ্রুর হিল্লোলে , 
    শুনিতেছ হাহাকার — 
তীর কোথা আছে দেখো মুখ তুলে , 
    এ সমুদ্র করো পার । 
মহা কলরবে সেতু বাঁধে সবে , 
    তুমি এসো , দাও যোগ — 
বাধার মতন জড়াও চরণ 
    এ কী রে করম - ভোগ । 
তা যদি না পারো সরো তবে সরো , 
    ছড়ে দাও তবে স্থান , 
ধুলায় পড়িয়া মরো তবে মরো — 
    কেন এ বিলাপগান ! 
  
ওরে চেয়ে দেখ্ মুখ আপনার , 
    ভেবে দেখ্ তোরা কারা , 
মানবের মতো ধরিয়া আকার , 
    কেন রে কীটের পারা ? 
আছে ইতিহাস , আছে কুলমান , 
    আছে মহত্ত্বের খনি — 
পিতৃপিতামহ গেয়েছে যে গান 
    শোন্ তার প্রতিধ্বনি । 
খুঁজেছেন তাঁরা চাহিয়া আকাশে 
    গ্রহতারকার পথ , 
জগৎ ছাড়ায়ে অসীমের আশে 
    উড়াতেন মনোরথ । 
চাতকের মতো সত্যের লাগিয়া 
    তৃষিত - আকুল - প্রাণে 
দিবসরজনী ছিলেন জাগিয়া 
    চাহিয়া বিশ্বের পানে । 
তবে কেন সবে বধির হেথায় , 
    কেন অচেতন প্রাণ — 
বিফল উচ্ছ্বাসে কেন ফিরে যায় 
    বিশ্বের আহ্বানগান ! 
মহত্ত্বের গাথা পশিতেছে কানে , 
    কেন রে বুঝি নে ভাষা ? 
তীর্থযাত্রী যত পথিকের গানে 
    কেন রে জাগে না আশা ? 
উন্নতির ধ্বজা উড়িছে বাতাসে , 
    কেন রে নাচে না প্রাণ ? 
নবীন কিরণ ফুটেছে আকাশে , 
    কেন রে জাগে না গান ? 
কেন আছি শুয়ে , কেন আছি চেয়ে , 
    পড়ে আছি মুখোমুখি — 
মানবের স্রোত চলে গান গেয়ে , 
    জগতের সুখে সুখী ! 
  
চলো দিবালোকে , চলো লোকালয়ে , 
    চলো জনকোলাহলে — 
মিশাব হৃদয় মানবহৃদয়ে 
    অসীম আকাশতলে । 
তরঙ্গ তুলিব তরঙ্গের'পরে , 
    নৃত্যগীত নব নব — 
বিশ্বের কাহিনী কোটি কণ্ঠস্বরে 
    এককণ্ঠ হয়ে কব । 
মানবের সুখ মানবের আশা 
    বাজিবে আমার প্রাণে , 
শত লক্ষ কোটি মানবের ভাষা 
    ফুটিবে আমার গানে । 
মানবের কাজে মানবের মাঝে 
    আমরা পাইব ঠাঁই , 
বঙ্গের দুয়ারে তাই শিঙা বাজে — 
    শুনিতে পেয়েছি ভাই ! 
মুছে ফেলো ধুলা , মুছ অশ্রুজল , 
    ফেলো ভিখারির চীর — 
পরো নব সাজ , ধরো নব বল , 
    তোলো তোলো নত শির । 
তোমাদের কাছে আজি আসিয়াছে 
    জগতের নিমন্ত্রণ — 
দীনহীন বেশ ফেলে যেয়ো পাছে , 
    দাসত্বের আভরণ । 
সভার মাঝারে দাঁড়াবে যখন , 
    হাসিয়া চাহিবে ধীরে , 
পুরবরবির হিরণ কিরণ 
    পড়িবে তোমার শিরে । 
বাঁধন টুটিয়া উঠিবে ফুটিয়া 
    হৃদয়ের শতদল , 
জগতমাঝারে যাইবে লুটিয়া 
    প্রভাতের পরিমল । 
উঠ বঙ্গকবি , মায়ের ভাষায় 
    মুমূর্ষুরে দাও প্রাণ — 
জগতের লোক সুধার আশায় 
    সে ভাষা করিবে পান । 
চাহিবে মোদের মায়ের বদনে , 
    ভাসিবে নয়নজলে — 
বাঁধিবে জগৎ গানের বাঁধনে 
    মায়ের চরণতলে । 
বিশ্বের মাঝারে ঠাঁই নাই বলে 
    কাঁদিতেছে বঙ্গভূমি , 
গান গেয়ে কবি জগতের তলে 
    স্থান কিনে দাও তুমি । 
এক বার কবি মায়ের ভাষায় 
     গাও জগতের গান — 
সকল জগৎ ভাই হয়ে যায় , 
    ঘুচে যায় অপমান । 






মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

পারিভাষিক শব্দ

প্রকৃতি ও প্রত্যয় H S C ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য

(খেয়া ) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর